আইন অঙ্গনে সমালোচনামূলক প্রথম ল জার্নাল

বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়াতে অনলাইন বিজ্ঞাপন এবং মার্কেটপ্লেসের নিয়ন্ত্রণ: নীতিগত ঘাটতি এবং সম্ভাব্য সংস্কার

বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলির উত্থান যেমন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, এবং ইউটিউব, পণ্য ও সেবা বিপণনের ক্ষেত্রে একটি বিশাল পরিবর্তন আনতে সহায়ক হয়েছে। কোটি কোটি সক্রিয় ব্যবহারকারী সমৃদ্ধ এসব প্ল্যাটফর্ম ডিজিটাল বিজ্ঞাপন এবং ই-কমার্সের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশে। তবে, ডিজিটাল মার্কেটিং দ্রুত বিকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন বিজ্ঞাপন এবং মার্কেটপ্লেসের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট এবং কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই প্রবন্ধে, বাংলাদেশে অনলাইন বিজ্ঞাপন এবং মার্কেটপ্লেসের নিয়ন্ত্রণে নীতিগত ঘাটতি এবং এই সমস্যাগুলির সমাধানে সম্ভাব্য সংস্কার নিয়ে আলোচনা করা হবে।

বাংলাদেশে অনলাইন বিজ্ঞাপন এবং মার্কেটপ্লেসের বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি ব্যবসা এবং ব্যক্তিদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত। বাংলাদেশে ফেসবুক প্রধান প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিত, এরপর ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, এবং টিকটকও জনপ্রিয়। এগুলির উপর বিজ্ঞাপন প্রচার খরচ কম, এবং ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় এটি বৃহৎ ব্যবসা থেকে শুরু করে ছোট ব্যবসাগুলির জন্য একটি আকর্ষণীয় মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অনলাইন মার্কেটপ্লেস যেমন ফেসবুক মার্কেটপ্লেস এবং ইনস্টাগ্রাম শপস ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ছোট ব্যবসাগুলি এই প্ল্যাটফর্মগুলির মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছে, যার মধ্যে রয়েছে পোশাক, ইলেকট্রনিক্স, এবং আরও অনেক কিছু। তবে, যেখানে এসব প্ল্যাটফর্মে ব্যবসায়িক সুবিধা রয়েছে, সেখানে কিছু সমস্যা যেমন ভোক্তা সুরক্ষা, প্রতারণামূলক কার্যক্রম এবং বিক্রেতাদের জন্য দায়বদ্ধতার অভাবও রয়েছে।

অনলাইন বিজ্ঞাপন এবং মার্কেটপ্লেসে নীতিগত ঘাটতি

বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়া বিজ্ঞাপন এবং মার্কেটপ্লেস নিয়ন্ত্রণে কিছু উল্লেখযোগ্য নীতিগত ঘাটতি রয়েছে:

১. অনলাইন বিজ্ঞাপন এবং ই-কমার্সের জন্য সুনির্দিষ্ট আইন এর অভাব

বাংলাদেশে কিছু বিদ্যমান আইন আছে যা ডিজিটাল কার্যক্রমে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ রাখে, যেমন আইসিটি অ্যাক্ট ২০০৬, কিন্তু এই আইনগুলো মূলত সাইবার অপরাধ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তার ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এসব আইন ডিজিটাল মার্কেটিং এবং অনলাইন বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট নয়। উদাহরণস্বরূপ, আইসিটি অ্যাক্টে অনলাইন বিজ্ঞাপন এবং ই-কমার্সের জন্য নির্দিষ্ট বিধান নেই।

২. ভোক্তা সুরক্ষা আইনের দুর্বলতা

বাংলাদেশে ভোক্তা সুরক্ষা আইনের মধ্যে কিছু আইন রয়েছে যেমন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯, তবে এই আইনগুলো প্রধানত ঐতিহ্যগত বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য তৈরি হয়েছে এবং এগুলি অনলাইন লেনদেনের সমস্যাগুলিকে সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে পারে না। বিশেষত, পণ্যের সত্যতা, ফেরত নীতি, এবং প্রতারণা থেকে ভোক্তাদের সুরক্ষা এই আইনে সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত নয়।

৩. অনলাইন বিজ্ঞাপনের স্বচ্ছতার অভাব

অনলাইন বিজ্ঞাপনগুলির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব একটি বড় সমস্যা। প্ল্যাটফর্মগুলো যেমন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, এবং ইউটিউব ব্যবসাগুলিকে নির্দিষ্ট লক্ষ্য গ্রাহকদের কাছে বিজ্ঞাপন পৌঁছানোর সুযোগ দেয়, কিন্তু এই বিজ্ঞাপনগুলির সত্যতা এবং নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে কোনও স্পষ্ট নিয়ম নেই। মিথ্যা বিজ্ঞাপন, প্রতারণামূলক প্র্যাকটিস এবং বিভ্রান্তিকর দাবি প্রায়ই দেখা যায়, কিন্তু সেগুলি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সুনির্দিষ্ট আইন এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নেই।

৪. অনলাইন বিক্রেতাদের কর ফাঁকি

অনেকে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটপ্লেসে যারা ব্যবসা পরিচালনা করছেন, তারা কর ফাঁকি দিচ্ছেন, কারণ তারা তাদের ব্যবসা সঠিকভাবে নিবন্ধন করেন না বা আয় রিপোর্ট করেন না। এতে ঐতিহ্যগত ব্যবসাগুলির তুলনায় অসামঞ্জস্যপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে, যেখানে ঐতিহ্যগত দোকানপাট কর পরিশোধ করছে, কিন্তু অনলাইন ব্যবসাগুলি তা এড়িয়ে যাচ্ছে।

কার্যকর নিয়ন্ত্রণের জন্য সম্ভাব্য সংস্কার

এই নীতিগত ঘাটতিগুলি সমাধান করতে এবং অনলাইন বিজ্ঞাপন এবং মার্কেটপ্লেস নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু সংস্কার গ্রহণ করা উচিত:

১. অনলাইন বিজ্ঞাপন এবং ই-কমার্সের জন্য সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন

সরকারকে একটি সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা উচিত যা শুধুমাত্র অনলাইন বিজ্ঞাপন এবং ই-কমার্সকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এই আইনে অনলাইন বিজ্ঞাপন, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের দায়িত্ব এবং অনলাইন মার্কেটপ্লেসের গাইডলাইনগুলি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা উচিত।

২. ভোক্তা সুরক্ষা আইনকে শক্তিশালী করা

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে সংশোধনী এনে অনলাইন কেনাকাটার সমস্যাগুলি মোকাবেলা করা উচিত। যেমন পণ্যের ফেরত ও ফেরত নীতি, পণ্যের সত্যতা এবং সমাধান প্রক্রিয়া সংক্রান্ত নির্দেশিকা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। অনলাইন বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠন করা যেতে পারে।

৩. ডিজিটাল বিজ্ঞাপন মানদণ্ড প্রবর্তন

অনলাইন বিজ্ঞাপনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে একটি ডিজিটাল বিজ্ঞাপন মানদণ্ড তৈরি করা উচিত। এতে স্পনসর্ড কনটেন্টের ঘোষণা, পণ্যের দাবি সঠিক হওয়া, এবং বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন প্রতিরোধের জন্য নিয়মাবলী অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোকে এসব মানদণ্ড মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে এবং নিয়ম ভাঙলে জরিমানা আরোপ করা যেতে পারে।

৪. কর পরিশোধ নিশ্চিত করা

সরকারকে অনলাইন বিক্রেতাদের কর পরিশোধের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা উচিত, যাতে তারা ঐতিহ্যগত ব্যবসায়ীদের মতো কর পরিশোধ করে। ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করা এবং কর পরিশোধে উত্সাহ দেওয়ার জন্য প্রণোদনা প্রদান করা যেতে পারে।

৫. সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি

বাংলাদেশ সরকার সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোর সাথে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে পারে যাতে তারা স্থানীয় আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করে। এই প্ল্যাটফর্মগুলিকে স্থানীয় অফিস স্থাপন এবং সরকারের সঙ্গে কাজ করার জন্য উৎসাহিত করা উচিত।

বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলির মাধ্যমে অনলাইন বিজ্ঞাপন এবং ই-কমার্সের দ্রুত বৃদ্ধির কারণে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। বর্তমান আইনগুলি যথেষ্ট না হলেও, সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন, ভোক্তা সুরক্ষা শক্তিশালী করা, বিজ্ঞাপন স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং কর পরিশোধ নিশ্চিত করতে উপযুক্ত সংস্কার করা যেতে পারে। সরকারের পাশাপাশি ব্যবসায়ী এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর সহযোগিতায় একটি নিরাপদ এবং ন্যায্য ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস তৈরি করা সম্ভব।

সূত্র

বাংলাদেশ আইন কমিশন, ই-কমার্স এবং ভোক্তা সুরক্ষা নিয়ে প্রতিবেদন (ঢাকা, বাংলাদেশ, ২০১৮)।

বাংলাদেশ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন ২০০৬।

বাংলাদেশ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯।

এস. আহমেদ, ‘বাংলাদেশে অনলাইন কেনাকাটা এবং এর চ্যালেঞ্জ’, ব্যবসা গবেষণা ও উন্নয়ন পত্রিকা (২০২২)।

এ. জোহরা, ‘অনলাইন বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ: একটি বৈশ্বিক পর্যালোচনা’, আন্তর্জাতিক ডিজিটাল মার্কেটিং জার্নাল (২০২১)।

এ. হোসেন, ‘ই-কমার্সে সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা: বাংলাদেশ প্রসঙ্গ’, ডিজিটাল কমার্স রিভিউ (২০২০)।

জে. খান, ‘বাংলাদেশে অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কর ব্যবস্থা’, বাংলাদেশ ট্যাক্স জার্নাল (২০২৩)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *