আইন অঙ্গনে সমালোচনামূলক প্রথম ল জার্নাল

বাংলাদেশে খাদ্যে রাসায়নিক ব্যবহারের প্রভাব: জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি ও বিধানগত দুর্বলতা

খাদ্যে রাসায়নিক ব্যবহারের বিষয়টি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে, এবং বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশের দ্রুত নগরায়ণ, শিল্পায়ন এবং কৃষিক্ষেত্রের সম্প্রসারণের ফলে কীটনাশক, খাদ্য সংযোজক ও সংরক্ষণকারীর ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও এসব রাসায়নিক খাদ্য সংরক্ষণ, স্থায়িত্ব বৃদ্ধি ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়, তবুও অতিরিক্ত বা অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে মারাত্মক জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। এই নিবন্ধে বাংলাদেশে খাদ্যে রাসায়নিক ব্যবহারের বর্তমান অবস্থা, এর কারণে সৃষ্ট জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি, এবং বিদ্যমান বিধানগত দুর্বলতাগুলো পর্যালোচনা করা হয়েছে।

খাদ্য উৎপাদনে রাসায়নিক ব্যবহারের বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনে রাসায়নিক ব্যবহারের প্রধান দুটি ক্ষেত্র হলো কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প। কৃষিতে কীটনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে ফসল সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করা হয়। তবে, অনিয়ন্ত্রিত ও মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে খাদ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি দেখা যায়, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।

একইভাবে, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পেও সংরক্ষণকারী ও খাদ্য সংযোজকের ব্যবহার ব্যাপক। যদিও নির্দিষ্ট মাত্রায় এসব রাসায়নিক ব্যবহার করা নিরাপদ, তবে বাংলাদেশে অনেক সময় এগুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে বা অতিরিক্ত ব্যবহৃত হয়।

বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হলো ফরমালিনের ব্যবহার, যা একটি নিষিদ্ধ রাসায়নিক সংরক্ষণকারী, তবুও মাছ, ফল ও শাকসবজিতে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফরমালিন একটি পরিচিত কার্সিনোজেন (ক্যানসার সৃষ্টিকারী পদার্থ) যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (BFSA) ও অন্যান্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনন্দিন খাদ্যে এসব ক্ষতিকর রাসায়নিকের উপস্থিতি আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন।

জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি

বাংলাদেশে খাদ্যে রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি মারাত্মক। দীর্ঘমেয়াদে এসব রাসায়নিকের সংস্পর্শে এলে নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ঝুঁকি হলো:

ক্যানসার ও অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগ: অতিরিক্ত কীটনাশক ও সংরক্ষণকারীর অবশিষ্টাংশ খাদ্যের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে, যা ক্যানসার, হৃদরোগ, এবং কিডনি বিকলতার মতো রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা: রাসায়নিক দ্রব্যের অতিরিক্ত গ্রহণ স্নায়ুতন্ত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যার ফলে স্মৃতিশক্তি হ্রাস, স্নায়বিক দুর্বলতা এবং শিশুদের মানসিক বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে।

শ্বাসকষ্ট ও চর্মরোগ: ফরমালিনযুক্ত খাবার খেলে ত্বকের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট, এবং পাকস্থলীর নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে।

খাদ্যে ভেজালজনিত সমস্যা: বাংলাদেশে দুধ, মশলা, মিষ্টি এবং অন্যান্য খাদ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশ্রণের ঘটনা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে তীব্র খাদ্য বিষক্রিয়া, অ্যালার্জি এবং দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।

বিধানগত দুর্বলতা

বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কিছু আইন ও নীতিমালা থাকলেও, বাস্তবায়নে দুর্বলতা এবং কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থার অভাব রয়েছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার সীমাবদ্ধতা: বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (BFSA) গঠন করা হলেও, পর্যাপ্ত বাজেট, জনবল ও সরঞ্জামের অভাবে এটি যথাযথভাবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না।

অসচেতনতা ও অনাগ্রহ: অনেক কৃষক, ক্ষুদ্র খাদ্য ব্যবসায়ী এবং বিক্রেতা খাদ্যে রাসায়নিক ব্যবহারের সঠিক নিয়ম সম্পর্কে সচেতন নন বা তারা আইন মেনে চলতে অনাগ্রহী। ফলে নিষিদ্ধ ও ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার অব্যাহত রয়েছে।

মানসম্পন্ন গাইডলাইন ও বাস্তবায়নের অভাব: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহারের মানদণ্ড নির্ধারণ করলেও বাংলাদেশে সেগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা হয় না।

সমস্যা সমাধানের উপায়

এই সমস্যাগুলো সমাধানে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা জরুরি:

খাদ্য নিরাপত্তা আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন: খাদ্য নিরাপত্তা আইন কার্যকর করতে BFSA-এর সক্ষমতা বাড়ানো এবং নিয়মিত পরিদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে।

সচেতনতামূলক প্রচারণা: কৃষক, ব্যবসায়ী এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে রাসায়নিক ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালানো জরুরি।

প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি: খাদ্য নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও কৃষকদের জন্য নিরাপদ কৃষি পদ্ধতি শেখানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

জৈব কৃষি ও নিরাপদ কৃষি পদ্ধতি প্রচার: কীটনাশকের পরিবর্তে জৈব কৃষি ও সমন্বিত পোকা দমন ব্যবস্থাপনা (IPM) গ্রহণ করার জন্য কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে।

পরীক্ষা ও মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা: খাদ্য নমুনা পরীক্ষার জন্য আরও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও পরীক্ষাগার স্থাপন করতে হবে এবং বাজার থেকে সরাসরি খাদ্য নমুনা সংগ্রহের ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি: WHO, FAO, এবং জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (UNEP) সঙ্গে সমন্বয় করে খাদ্য নিরাপত্তা মান উন্নত করা যেতে পারে।

উপসংহার

বাংলাদেশে খাদ্যে রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কীটনাশক, সংরক্ষণকারী ও খাদ্য সংযোজকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার খাদ্যে বিষক্রিয়ার মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে জনস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যদিও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কিছু আইন ও নীতিমালা রয়েছে, বাস্তবায়নে দুর্বলতা থাকায় কার্যকর মনিটরিং সম্ভব হচ্ছে না।

এ সমস্যা সমাধানে সরকারকে কঠোর আইন বাস্তবায়ন, সচেতনতা বৃদ্ধি, নিরাপদ কৃষি পদ্ধতির প্রসার এবং খাদ্য পরীক্ষার সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে, বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

তথ্যসূত্র

1. Bangladesh Food Safety Authority, Food Safety and Standards in Bangladesh, (BFSA, 2023).

2. World Health Organization, Pesticide Residue in Food and Drinking Water: Human Health Effects, (WHO, 2022).

3. Food and Agriculture Organization, International Code of Conduct on Pesticide Management, (FAO, 2021).

4. Md. Saiful Islam et al., ‘Formalin Contamination in Fish and Its Impact on Public Health in Bangladesh’ Bangladesh Journal of Public Health (2020) 35(4): 155-161.

5. Abdul Kadir et al., ‘Food Adulteration and the Use of Harmful Chemicals in Bangladesh: Asian Journal of Food Safety (2019)  23(2): 101-115.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *