ভূমিকা
শ্রমিক অধিকার কর্মক্ষেত্রে ন্যায়বিচার, সমতা এবং মর্যাদা নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে শ্রমশক্তির একটি বিশাল অংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত এবং অনেক শ্রমিক আনুষ্ঠানিক শ্রম আইনের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত, সেখানে শ্রমিক অধিকারের সুরক্ষা একটি চলমান চ্যালেঞ্জ। অন্যান্য শ্রমিক অধিকারের মধ্যে, পিতৃত্বকালীন ছুটি একটি নতুন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু, যা পুরুষ কর্মীদের পরিবারকে সময় দেওয়ার অধিকারকে কেন্দ্র করে গঠিত। এই প্রবন্ধে বাংলাদেশের শ্রম অধিকার, বিশেষত পিতৃত্বকালীন ছুটির আইনি চ্যালেঞ্জ, সামাজিক প্রভাব এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশে শ্রম অধিকার
বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকারের মূল ভিত্তি হলো বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬। এই আইনে ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা এবং শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
তবে, আইন থাকলেও এর বাস্তবায়নে বিভিন্ন বাধা রয়ে গেছে। বিশেষত, বাংলাদেশের বিশাল অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করা শ্রমিকরা — যেমন কৃষি, নির্মাণ, এবং পোশাক শিল্পে — এই সুরক্ষাগুলো থেকে বঞ্চিত। এসব ক্ষেত্রে শ্রমিকরা দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, কম মজুরি এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মুখোমুখি হন, অথচ শ্রম আইন অনুযায়ী তারা কোনো সুবিধাই পান না।
অন্যদিকে, দুর্নীতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং শ্রমিকদের নিজেদের অধিকারের বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে শ্রম আইন কার্যকর করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে আইন ও বাস্তবতার মধ্যে বড় একটি ফাঁক থেকে যায়।
বাংলাদেশে পিতৃত্বকালীন ছুটি: আইনি কাঠামো ও বাস্তবায়ন
পিতৃত্বকালীন ছুটি অনেক দেশের জন্য নতুন ধারণা হলেও, বাংলাদেশে এটি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এ মূলত মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যেখানে নারী শ্রমিকরা ১৬ সপ্তাহের পূর্ণ বেতনের ছুটির অধিকারী।
কিন্তু পুরুষ শ্রমিকদের জন্য পিতৃত্বকালীন ছুটির কোনো আইনগত স্বীকৃতি নেই। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিজেদের উদ্যোগে পিতৃত্বকালীন ছুটি প্রদান করলেও, এটি সর্বজনীন বা বাধ্যতামূলক নয়।
এ ধরনের ছুটির অনুপস্থিতি শুধুমাত্র বাবাদের জন্য সমস্যা তৈরি করে না; বরং এটি পরিবারকেন্দ্রিক সহায়তার কাঠামো এবং কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ সমতার ধারণার বিরুদ্ধেও যায়। পুরুষরা তাদের নবজাতকের যত্নে যুক্ত হতে না পারায় পরিবার এবং সমাজের মধ্যে একটি পুরনো লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন আরও দৃঢ় হয়।
বাংলাদেশের শ্রম অধিকারের বাস্তবায়নে আইনি চ্যালেঞ্জসমূহ
বাংলাদেশে শ্রম আইনের বাস্তবায়নে কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান।
মাতৃত্বকালীন ছুটির বাস্তবায়ন: বড় প্রতিষ্ঠান এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সাধারণত শ্রম আইন অনুসরণ করলেও, ছোট ব্যবসা এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানেই মাতৃত্বকালীন ছুটি কার্যকর হয় না।
পিতৃত্বকালীন ছুটির অনুপস্থিতি: এটি কেবল একটি আইনগত ফাঁক নয়, বরং এটি পরিবার এবং কর্মসংস্কৃতির উন্নয়নে বাধা।
অন্যান্য শ্রম অধিকার লঙ্ঘন: স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা, ন্যায্য মজুরি এবং সামাজিক নিরাপত্তার মতো অন্যান্য শ্রম অধিকারের বাস্তবায়নও দুর্বল।
বাংলাদেশে শ্রম আইনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা এখনো পুরুষতান্ত্রিক ধারণায় আবদ্ধ। শিশুর যত্ন এককভাবে মায়ের দায়িত্ব বলে মনে করা হয়। ফলে পিতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে জনসচেতনতা কম, এবং পুরুষরাও নিজেদের দায়িত্ব বলে মনে করেন না।
এর ফলে নারীরা দ্বিগুণ চাপের মুখে পড়েন — শিশুর যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি তাদের চাকরিও বজায় রাখতে হয়। এর প্রভাব পড়ে শিশুদের বিকাশেও, কারণ বাবার উপস্থিতি শিশুর মানসিক ও সামাজিক বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের শ্রম আইন সংস্কারের মাধ্যমে একটি সমতাভিত্তিক ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, যেখানে বাবা-মা দুজনেই সন্তানের যত্ন নেওয়ার সুযোগ পাবেন।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে পিতৃত্বকালীন ছুটি
আন্তর্জাতিকভাবে পিতৃত্বকালীন ছুটি অনেক দেশে আইনগতভাবে স্বীকৃত।
সুইডেন ও নরওয়ে-র মতো স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে পিতৃত্বকালীন ছুটিকে শুধু বাবাদের অধিকার নয়, বরং লিঙ্গ সমতা ও শিশুর কল্যাণ নিশ্চিত করার মাধ্যম হিসেবে দেখা হয়।
বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশ-এ এখনো এটি বিলাসিতা হিসেবেই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক মডেলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে পিতৃত্বকালীন ছুটিকে শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করা, এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধাগুলো দূর করার পদক্ষেপ নেওয়া।
উপসংহার
বাংলাদেশে শ্রম অধিকার উন্নয়নের পথে কিছু অগ্রগতি হলেও, এখনো অনেক দূর এগোতে হবে — বিশেষত পিতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করতে।
এ ধরনের ছুটি কেবল একজন বাবা বা পরিবারকে সহায়তা করবে না; বরং এটি সমাজে লিঙ্গ সমতা এবং শিশুর কল্যাণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আইনি সংস্কার, সামাজিক মনোভাব পরিবর্তন এবং বিদ্যমান শ্রম আইন কার্যকর করার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি আরও ন্যায়সঙ্গত কর্মসংস্কৃতি তৈরি করতে পারে।
তথ্যসূত্র
- Bangladesh Labor Act, 2006, Section 46.
- International Labour Organization (ILO), Maternity Protection Convention, C183, 2000, https://www.ilo.org/dyn/normlex/en/f?p=NORMLEXPUB:12100:0::NO::P12100_INSTRUMENT_ID:312327
- Bangladesh, Ministry of Labor and Employment, The Labor Law in Bangladesh: An Overview (2017), http://www.moem.gov.bd/
- United Nations Development Programme (UNDP), Human Development Report 2020: The Next Frontier (UNDP, 2020).
- Håkan Gustafsson, The Swedish Model of Parental Leave: A Comparative Analysis (Swedish Institute, 2018), https://si.se/en/
- World Bank, Bangladesh: Labor Market and Employment Policy Review (World Bank, 2019), https://www.worldbank.org/en/country/bangladesh
- George H. Simons, Paternity Leave and Gender Equality in the Workplace: A Global Perspective (Oxford University Press, 2015).
- OECD, OECD Family Database: Maternity and Paternity Leave (OECD, 2020), http://www.oecd.org/els/family/database.htm