ভূমিকা:
জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ বিপ্লবের এক বিশাল সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে এসে বর্তমান পরিস্থিতিতে বিরাজ করছে। যে পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা সকলে ওয়াকিবহাল। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে আমরা ভেবেছিলাম যে দেশে একটি বিপ্লবের সূচনা হবে। সেটা তো হলই না, এমনকি কোন সংস্কারও এখনো পর্যন্ত কার্যকর হলো না। এছাড়া দেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়েছে। যার সুযোগ নিয়ে কিছু মানুষ সমাজের সেচ্ছাচারিতা করছে। চাঁদাবাজ, সন্ত্রাস, চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, খুন, গুম ইত্যাদি এখনকার নিত্যদিনের ঘটনা। এর মূল কারণ দেশের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি, দুর্বল আইন, আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাব, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতা, স্থানীয় সরকারি কার্যক্রম দুর্বল হয়ে পড়া, বৃহত্তর রাজনৈতিক গোষ্ঠীদ্বয়ের ব্যাপক প্রভাব ইত্যাদি।
এতক্ষণ সমস্যাময়িক বর্ণনা করলাম। এখন আমরা দেখব সমসাময়িক পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক আইনের সীমাবদ্ধতা ও এর থেকে পরিত্রাণের উপায়।
✔(১.) সাংবিধানিক আইনের সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালে গৃহীত হলেও, এর বিভিন্ন বিধান এবং পরবর্তী সংশোধনীগুলো সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:
◑ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ
সমস্যা: সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী এবং কার্যনির্বাহী বিভাগের হাতে অত্যধিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। উদাহরণস্বরূপ, সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা সীমিত করা হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা এবং স্বাধীনতাকে প্রভাবিত করে।
প্রভাব: এটি ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজনৈতিক প্রভাব এবং সংসদের স্বাধীনতা হ্রাসের কারণ হতে পারে। এ আইনটি সংস্কার করে সংবিধানে ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সংসদ সদস্যের হাতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষমতা থাকলে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ অসম্ভবপর। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
◑নির্বাচনী ব্যবস্থার দুর্বলতা
সমস্যা: সংবিধানে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলেও, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে এর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থাৎ ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক এবং জনগণের আস্থার ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
প্রভাব: এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে।
◑ প্রতিরোধমূলক আটক এবং মানবাধিকার
সমস্যা: সংবিধানের ৩৩ নং অনুচ্ছেদ প্রতিরোধমূলক আটকের বিধান রাখে, যা বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪-এর মাধ্যমে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে। এই আইন বিচার ছাড়া আটকের সুযোগ দেয়, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের কারণ হয়েছে।
প্রভাব: এটি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই কালো আইনকে কাজে লাগিয়ে তথাকথিত স্বৈরাচার ‘আয়না ঘর’ এর মতো জঘন্য এবং আইন বিরোধী একটি সেল প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।
◑ সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়ার জটিলতা
সমস্যা: সংবিধানের ১৪২ নং অনুচ্ছেদে সংশোধনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন, যা রাজনৈতিক ঐকমত্যের অভাবে কঠিন।
প্রভাব: জরুরি সংস্কার বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটে, যা সংবিধানকে সমসাময়িক চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করতে বাধা সৃষ্টি করে।
◑ সামাজিক সমস্যা মোকাবিলায় সীমাবদ্ধতা
সমস্যা: সংবিধানে সামাজিক সমতা, নারী-পুরুষের সমান অধিকার এবং মানবাধিকারের কথা বলা হলেও, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নারীর প্রতি সহিংসতা, শিশুশ্রম এবং দুর্নীতির মতো সমস্যা মোকাবিলায় সাংবিধানিক বিধান কার্যকরভাবে প্রয়োগ হয় না।
প্রভাব: এটি সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সমতা প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি করে।
✔(২.) সমাধানের উপায়
সাংবিধানিক আইনের সীমাবদ্ধতা দূর করতে এবং সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:
ক. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ
প্রস্তাব: সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা। এছাড়া, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা।
ফলাফল: এটি ক্ষমতার অপব্যবহার কমাবে এবং গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা বাড়াবে।
খ. নির্বাচনী সংস্কার
প্রস্তাব: নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করতে সাংবিধানিক সংস্কার এবং নিরপেক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রবর্তন। এছাড়া, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ইলেকট্রনিক ভোটিং এবং পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করা।
Separation of power নিশ্চিত করতে হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনে সংসদ সদস্য বা রাষ্ট্রপতির কোন হাত থাকবে না। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচিত করা যেতে পারে।
ফলাফল: জনগণের আস্থা ফিরবে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী হবে।
◑ মানবাধিকার সুরক্ষা
প্রস্তাব: সংবিধানের ৩৩ নং অনুচ্ছেদ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন সংশোধন করে প্রতিরোধমূলক আটকের বিধান সীমিত করা। স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন গঠন এবং বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
ফলাফল: মানবাধিকার লঙ্ঘন কমবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।
◑ সংবিধান সংস্কার কমিশন
প্রস্তাব: সাম্প্রতিক জুলাই বিপ্লবের পর অধ্যাপক আলী রিয়াজের নেতৃত্বে গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন। এর মধ্যে রয়েছে নতুন সংবিধান প্রণয়ন, নাগরিকতন্ত্র প্রবর্তন এবং মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।
ফলাফল: সংবিধান সমসাময়িক চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হবে।
◑ সামাজিক সমস্যা মোকাবিলায় আইনের প্রয়োগ
প্রস্তাব: নারীর প্রতি সহিংসতা, শিশুশ্রম এবং দুর্নীতির মতো সমস্যা মোকাবিলায় বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা। দুর্নীতি দমন কমিশনকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা।
ফলাফল: সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সমতা প্রতিষ্ঠায় অগ্রগতি হবে।
◑ জনঅংশগ্রহণ বৃদ্ধি
প্রস্তাব: সংবিধান সংস্কারে জনগণের মতামত গ্রহণের জন্য গণভোট বা জনশুনানির ব্যবস্থা করা। এছাড়া, সুশীল সমাজ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তোলা।
ফলাফল: সংবিধানের গ্রহণযোগ্যতা এবং জনগণের আস্থা বাড়বে।
◑ বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ
রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির অভাব: সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রয়োজন, যা বর্তমানে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রতিরোধ: কিছু রাজনৈতিক দল এবং স্বার্থগোষ্ঠী সংস্কারের বিরোধিতা করতে পারে।
সম্পদের সীমাবদ্ধতা: সংস্কার বাস্তবায়নে আর্থিক এবং প্রশাসনিক সম্পদের প্রয়োজন, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য চ্যালেঞ্জিং।
◑ উপসংহার
বাংলাদেশের সংবিধান সমসাময়িক সমস্যা মোকাবিলায় কিছু ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করে, যা ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, এবং ধর্মীয় ও সামাজিক বৈষম্যের মতো বিষয়গুলোতে স্পষ্ট। এই সীমাবদ্ধতা দূর করতে সংবিধান সংস্কার, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, নির্বাচনী ব্যবস্থার উন্নয়ন, এবং সামাজিক সমতার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হলে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।