১.ভূমিকা
ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার ও ইন্টারনেট ব্যবহারের বিস্তৃতির ফলে বাংলাদেশে অনলাইন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ এবং সাইবার অপরাধ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার ২০০৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন (আইসিটি অ্যাক্ট) প্রণয়ন করে। এই আইনের বিভিন্ন ধারা মধ্যে ৫৭ ধারা অত্যন্ত বিতর্কিত হয়ে ওঠে এর অস্পষ্ট ভাষা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেওয়া অতিরিক্ত ক্ষমতার জন্য। মূলত মানহানি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে জনশৃঙ্খলা বিনষ্টকারী বিষয়বস্তু রোধ করার উদ্দেশ্য থাকলেও, ৫৭ ধারা পরবর্তীতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করার অভিযোগের মুখে পড়ে। এই প্রবন্ধে ৫৭ ধারার বিবর্তন, প্রয়োগ, সমালোচনা, এবং এর বিলুপ্তি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
২.২০০৬ সালের আইসিটি আইনের পটভূমি
আইসিটি আইন, ২০০৬ ছিল বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ আইন যা ডিজিটাল স্পেসে সংঘটিত অপরাধ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে তৈরি। অনলাইন আচরণ নিয়ন্ত্রণ, ইলেকট্রনিক লেনদেন সুরক্ষা এবং হ্যাকিং, পরিচয় চুরি ও অনলাইন জালিয়াতি প্রতিরোধ ছিল এর লক্ষ্য। তবে, ৫৭ ধারা ২০১৩ সালে সংশোধিত হওয়ার আগে তেমন নজরে আসেনি।
২০১৩ সালের সংশোধনীতে ৫৭ ধারার শাস্তি বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ৭ থেকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড এবং মোটা অংকের জরিমানা নির্ধারণ করা হয়। এতে বলা হয়:
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত,
ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মানহানি,
বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি,
রাষ্ট্রের বা কারো সম্মান ক্ষুণ্ণ করা।
এছাড়া, ৫৭ ধারার অপরাধগুলো অজামিনযোগ্য করা হয়, ফলে পুলিশ ওয়ারেন্ট ছাড়াই কাউকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা পায়। এতে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
৩.৫৭ ধারার ভাষা ও পরিসর
৫৭ ধারার বড় সমস্যা ছিল এর অস্পষ্ট ও ব্যাপক ভাষা। “ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত,” “মানহানি,” এবং “রাষ্ট্রের সম্মান ক্ষুণ্ণ” এসবের স্পষ্ট সংজ্ঞা না থাকায়, পুলিশ ও প্রশাসন নিজেদের মতো করে তা ব্যাখ্যা করে প্রয়োগ করত। এতে বিরোধী রাজনীতিক, সাংবাদিক, এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা প্রায়শই হয়রানির শিকার হতেন।
বৈধ সমালোচনা, ব্যঙ্গচিত্র, বা প্রকৃত ক্ষতিকর বিষয়বস্তুর মধ্যে পার্থক্য করার সুযোগ ছিল না। এর ফলে মানুষ নিজের মত প্রকাশে ভয় পেতে শুরু করে এবং স্বয়ং সেন্সরশিপ বাড়ে।
৪.বাস্তবায়ন ও পরিণতি
২০১৩ সালের সংশোধনের পর ৫৭ ধারার প্রয়োগ ব্যাপকভাবে শুরু হয়। পুলিশ, সাংবাদিক, ব্লগার, ছাত্র এবং সাধারণ মানুষকে ফেসবুকের পোস্ট, মন্তব্য, অথবা কনটেন্ট শেয়ার করার জন্য গ্রেফতার করে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০১৩ সালে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন ধর্মবিরোধী লেখালেখির অভিযোগে গ্রেফতার হন। ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যার আগেও ৫৭ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছিল। অনেক সাংবাদিক কেবলমাত্র প্রভাবশালী ব্যক্তি বা সরকারের সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করার জন্য হয়রানির শিকার হন।
এ ধরনের গ্রেফতারে সঠিক তদন্তের অভাব, দীর্ঘদিন হাজতে থাকা, এবং বিচারপ্রক্রিয়ার ধীরগতির কারণে সমাজে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়।
৫.বিচার বিভাগের প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা
যদিও আদালত মাঝে মাঝে অভিযুক্তদের জামিন দিয়েছে, তবুও অপরাধের অজামিনযোগ্যতা আদালতের ক্ষমতা সীমিত করেছিল। বিচার বিভাগ নির্বিচারে আইনের প্রয়োগ রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন ৫৭ ধারা নিয়ে সমালোচনা করে বলেছিল যে, এটি সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত চিন্তা, বিবেক ও বাক-স্বাধীনতা লঙ্ঘন করে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-সহ বিভিন্ন সংস্থা অভিযোগ করে যে, ৫৭ ধারা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি, বিশেষ করে আইসিসিপিআর এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
৬.জনমত ও গণমাধ্যমের প্রতিক্রিয়া
৫৭ ধারার অপব্যবহার ঘিরে নাগরিক সমাজ, মিডিয়া, ও সাধারণ জনগণের তীব্র প্রতিবাদ সৃষ্টি হয়। গণমাধ্যম কর্মীরা একে মিডিয়া স্বাধীনতার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখেন। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের কাছে এটি ডিজিটাল অধিকার হরণ হিসেবে প্রতিভাত হয়।
দেশজুড়ে বিভিন্ন সেমিনার, সভা, এবং আন্দোলনের মাধ্যমে এই ধারা বাতিলের দাবি ওঠে। মানবাধিকার কর্মীরা এটিকে রাজনৈতিক বিরোধিতা দমন করার হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেন।
৭.৫৭ ধারার বিলুপ্তি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮
সরকার এই সমালোচনার মুখে ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) প্রণয়নের মাধ্যমে ৫৭ ধারা বাতিল করে। এই আইন ডিজিটাল অপরাধ মোকাবেলায় নতুন কাঠামো তৈরি করে।
কিন্তু ডিএসএর ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১ ধারা অনেকের কাছে ৫৭ ধারার নতুন সংস্করণ মনে হয়েছে। যেমন:
২৫ ধারা: অপমানজনক, মিথ্যা বা ভীতিকর তথ্য প্রকাশ।
২৮ ধারা: ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত।
২৯ ধারা: মানহানি।
৩১ ধারা: জনশৃঙ্খলা বিপন্নকারী ডিজিটাল যোগাযোগ।
ফলে, ৫৭ ধারা বাতিল হলেও মূল সমস্যা রয়ে গেছে, বিশেষ করে অস্পষ্ট সংজ্ঞা ও বিচারিক সুরক্ষা না থাকার কারণে।
৮.আন্তর্জাতিক তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি
অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করলে, বাংলাদেশে ৫৭ ধারা এবং ডিএসএ তুলনামূলকভাবে কঠোর। যেমন:
ভারতে, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারা ২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে, অস্পষ্ট ভাষার কারণে।
যুক্তরাজ্যে, ম্যালিসিয়াস কমিউনিকেশনস অ্যাক্ট স্পষ্ট সংজ্ঞা এবং যথেষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়।
এই উদাহরণগুলো দেখায়, আইনের স্পষ্টতা, বিচারিক নজরদারি, এবং বাক-স্বাধীনতা রক্ষা জরুরি।
৯.বাক-স্বাধীনতা ও ডিজিটাল অধিকারে প্রভাব
৫৭ ধারার উত্তরাধিকার হিসেবে বাংলাদেশে বাক-স্বাধীনতার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আজও সাংবাদিক, লেখক, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা মত প্রকাশে ভয় পান। এই চিলিং ইফেক্ট দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ডিএসএ-এর অধীনে একই ধরনের বিধান থাকায় বাক-স্বাধীনতা আজও সংকুচিত। সার্বিক সংস্কার ছাড়া ডিজিটাল অধিকার নিরাপদ হবে না।
১০.আইন সংস্কারের সুপারিশ
ডিজিটাল নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য কিছু সুপারিশ:
১. স্পষ্ট সংজ্ঞা: মানহানি, ঘৃণাত্মক বক্তব্য, ধর্মীয় অবমাননার নির্ভুল সংজ্ঞা দিতে হবে।
২. বিচারিক অনুমোদন: অনলাইন বিষয়বস্তু নিয়ে গ্রেফতারে আদালতের অনুমতি বাধ্যতামূলক।
৩. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ: ডিজিটাল অধিকার, মানবাধিকার ও সাইবার আইন প্রয়োগে প্রশিক্ষণ।
৪. স্টেকহোল্ডার পরামর্শ: আইন প্রণয়নে নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক, আইনজ্ঞদের মতামত নিতে হবে।
৫. সচেতনতা বৃদ্ধি: নাগরিকদের ডিজিটাল অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
১১.উপসংহার
আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা দেখিয়েছে কিভাবে অস্পষ্ট ও ব্যাপক আইন মৌলিক অধিকার দমন করতে পারে। যদিও এর উদ্দেশ্য ছিল সমাজকে সুরক্ষা দেয়া, বাস্তবে এটি মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
৫৭ ধারা বাতিল ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও পরবর্তী আইনে একই ধরনের বিধান থাকায় সমস্যার সমাধান হয়নি। সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড মেনে সাইবার আইন সংস্কার জরুরি।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে স্বচ্ছ আইন প্রণয়ন করে বাংলাদেশ নিরাপত্তা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার মধ্যে ভারসাম্য আনতে পারে। তবেই ডিজিটাল প্রযুক্তির সুফল ভোগের সাথে নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব