ভূমিকাঃসমাজ একটি চলমান সংগঠন যেখানে বিবাদ অবশ্যম্ভাবী এবং নিয়মিত তা ঘটেই যাচ্ছে। একই সমাজে বসবাস বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ যেখানে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীর মানুষ যোগ্যতা, আর্থিক অবস্থা একেক রকম। যার ফলে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলো নিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষজন আদালত পর্যন্ত যেতে সাহস পায় না।
তবে তা যে কেবল নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য এমনটি নয়। সকল শ্রেণিগোষ্ঠীর মানুষদের জন্য এই আদালত কাজ করে থাকে। এই অস্থায়ী আদালতটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলো সমাধান করার ফলে স্থায়ী আদালতগুলোর উপর অনেক চাপ কমে আসছে।
গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ এটি মূলত বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলে স্থানীয় পর্যায়ে দ্রুত ও সহজে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি একটি অনানুষ্ঠানিক বিচার ব্যবস্থা, যা স্থানীয় বিবাদ নিষ্পত্তির পাশাপাশি সমাজের শান্তি এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তবে এই আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে বেশ কিছু জটিলতা রয়েছে, যা ন্যায়বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। এই নিবন্ধে গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬-এর প্রয়োগে জটিলতাগুলো চিহ্নিত করে তা থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে আলোচনা করা হবে।
গ্রাম আদালত গঠনের প্রক্রিয়াঃগ্রাম আদালত পূর্ব নির্ধারিত প্রচলিত আদালতের মত কোনো আদালত নয়।এই আইনটির ২(ঙ) ধারায় বলা হয়েছে আইনটির ৫ ধারা মোতাবেক গঠিত হবে উক্ত আদালত। একজন চেয়ারম্যান এবং উভয় পক্ষ থেকে মনোনীত দুইজন করে সদস্য নিয়ে মোট পাঁচজন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে এই গ্রাম আদালত।
তবে, উভয় পক্ষের এই দুই সদস্যদের একজনকে ইউনিয়ন পরিষদের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি হতে হবে।
তবে যদি কোনো পক্ষ মনে করে চেয়ারম্যান নিরপেক্ষভাবে বিচারটি করবেন না তবে চেয়ারম্যানের স্থলাভিষিক্ত অন্য কাউকে করা হবে। তবে, বিচার্য মামলায় যদি কোনো নারীর স্বার্থ জড়িত থাকে তবে এই দুই সদস্যদের মধ্যে অবশ্যই একজন নারী হতে হয়।
তাছাড়া, ইউনিয়ন পরিষদের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ব্যতীত যদি কেউ অন্য কাউকে সদস্য করতে চায় সেক্ষেত্রে চেয়ারম্যানের অনুমতি সাপেক্ষে সেটা করা যেতে পারে।
গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬-এর উদ্দেশ্যঃ
২১ টি ধারা এবং ১ টি তফসিল সম্বলিত গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬-এর মূল উদ্দেশ্য হলো স্থানীয় তথা ইউনিয়ন পর্যায়ে দ্রুত ও সহজে ছোট ছোট বিরোধ নিষ্পত্তি করা। এটি গ্রামীণ প্রান্তিক পর্যায়ের জনগণের জন্য একটি সহজলভ্য ও ব্যয় সাশ্রয়ী বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। এই আদালতের মাধ্যমে স্থানীয় নেতা ও সম্মানিত ব্যক্তিরা বিবাদ নিষ্পত্তি করেন, যা সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
গ্রাম আদালতের এখতিয়ারঃ গ্রাম আদালত আইন,২০০৬ এর একটি তফসিল রয়েছে। এখানেই উল্লেখ রয়েছে এর এখতিয়ার সম্পর্কে যেখানে বিষয়গুলো সুস্পষ্ট নির্ধারিত। গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ এর ৩ ধারার বর্ণনা অনুসারে তফসিলটির প্রথম অংশে উল্লেখিত ফৌজদারী মামলার ২৬ টি অপরাধ এবং দ্বিতীয় বা শেষ অংশে উল্লেখিত দেওয়ানি মামলার ৭ টি অপরাধ বিচারযোগ্য হবে।একটি গ্রাম আদালত উক্ত অপরাধগুলোর বিচার করতে সক্ষম।
ফৌজদারি অপরাধগুলোর ধরণ যেমন ১০ জনের বেআইনি সমাবেশে যোগদান বা দাঙ্গা ঘটানোর উদ্দেশ্য যোগদান,দুই বা ততোধিক ব্যক্তি কর্তৃক প্রকাশে মারামারি বা ঝগড়া, কোনো ব্যক্তিকে তার চলাচলে বাধা প্রদান, সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা মূল্যের সম্পত্তি গবাদি পশু চুরি বা অন্য কোনো সম্পত্তি চুরি ইত্যাদি।
গ্রাম আদালত কেবল দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারে।
দেওয়ানি মামলাগুলোর ধরণ যেমন স্ত্রী কর্তৃক ভরণপোষণের বকেয়া অর্থ আদায়ের মামলা, কোনো দলিল মূল্যে অর্থ আদায়ের মামলা, গবাদি পশুর অনাধিকারের ফলে তার জন্য ক্ষতিপূরণের মামলা ইত্যাদি। তবে এই অর্থের পরিমাণ সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা হতে পারবে তবেই তার গ্রাম আদালতে বিচারযোগ্য হবে।
ন্যায় বিচার প্রদানে জটিলতাঃ গ্রাম আদালত সাধারণত গঠিত হয় একজন চেয়ারম্যান এবং দুই পক্ষের দুজন করে সদস্য নিয়ে চারজন অর্থাৎ মোট পাঁচজন সদস্য নিয়ে গঠিত হয়। এই আদালতে যারা দ্বারস্থ হোন তাদের বেশিরভাগই গরীব ও অশিক্ষিত।
এই দিকটা বেশ দুর্বলভাবে গ্রহণ গ্রামপতিরা।এখানে যে কমিটি বিচার সালিশে বসে তাদের অনেকেই উৎকোচ গ্রহণ করে এক পাক্ষিক ফলাফল ঘোষণা করে যা ন্যায় বিচারের অন্তরায়।
আবার, গ্রামীণ সমাজে একঘরে করে দেওয়ার মতো এক বিশ্রী কালচার বিরাজ করে যার মুখ্য ভূমিকা পালন করে সমাজপতিরা। মূলত যারা বিচারকার্যে ভূমিকা রাখেন বা অংশগ্রহণ করেন তারা সমাজপতি হয়ে থাকেন। যার ফলে কেউ যদি তাদের বিচারে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন অনেক সময় সেইসব পরিবারকে একঘরে করে দেওয়ার মাধ্যমে তাদের কৌশলে অপমানিত করা হয়।যার ফলে ন্যায়বিচার পরিলক্ষিত হয় না।
আবার, যারা বিচারকার্যে থাকেন তারাই অনেকাংশে অশিক্ষিত৷ বর্তমানে যারা চেয়্যারম্যান হোন তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ ডিগ্রিধারী হতে হয় না।
সঙ্গত কারণেই ন্যায় বিচার ব্যাহত হয়।
গ্রাম আদালতের এখতিয়ার এক অন্যতম বাধাঁ ন্যায় বিচার প্রদানের। ফৌজদারি বিষয়গুলোর যেখানে সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা স্থায়ী কোর্টগুলো রাখে সেখানে শুধু জরিমানা প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই শাস্তি মূলত গ্রাম আদালতের ক্ষমতার ক্ষীণতাকে প্রকাশ করে থাকে। যারফলে বাদী উপযুক্ত ন্যায় বিচার পান না।
আবার দেওয়ানীর বিষয়গুলো প্রমাণের জন্য উপযুক্ত কৌশলী প্রযুক্তি সাধারণ গ্রাম আদালতে থাকে না। যার ফলে, এই গ্রাম আদালত ন্যায় বিচার প্রদান করতে সক্ষম হয় না।
আবার, যদি কোনো পরিবারের কর্তা পুরুষ না থেকে নারী হয় অর্থাৎ যে পরিবারে পুরুষ নাই সে পরিবার যদি ঐ আদালতের দ্বারস্থ হয় তবে সেখানকার পুরুষ সুযোগ সন্ধানের আশায় থাকে। এটা একটা বিশাল অন্তরায়।
উত্তরণের উপায় ও পরামর্শঃ
গ্রাম আদালত পরিচালনার জন্য যে কমিটি গঠিত হয় তার সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। কমপক্ষে দশ সদস্যের যথেষ্ট শিক্ষিত হওয়া উচিত।
কমিটির প্রত্যেকজনকে নিদিষ্ট স্তর পর্যন্ত শিক্ষিত হতে হবে। ন্যূনতম তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক সম্পন্ন হওয়া চাই।
নারীদের বিচারের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা যাতে তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়। এক্ষেত্রে বিশেষ ট্রায়াল রুমের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।
চূড়ান্ত রায়ের দিন অধস্তন আদালতের যেকোনো ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে রায় প্রদান।
যেখানে ফৌজদারি মামলার বিষয়গুলোর সর্বোচ্চ সাজা ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া যেতে পারে সেখানে গ্রাম আদালতকে এতটুকু এখতিয়ার দেওয়ার দরকার যাতে কোনো অধস্তন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ন্যূনতম দুই বছরের কারাদণ্ডে দন্ডিত করতে পারে। এর জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের পাশাপাশি ঐ ইউনিয়ন যে থানার অন্তর্ভুক্ত সেই থানার ওসির উপস্থিতি নিশ্চিত করা দরকার।
গ্রাম আদালত গুলোতে যেহেতু পক্ষ পাতিত্বের সম্ভাবনা বেশি থাকে সুতরাং সেদিকে বিশেষ নজর রাখা।
একটি দেশের যেসব অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি নারীদের অবস্থা শোচনীয় যেমন উত্তরাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম এসব অঞ্চলে গ্রাম আদালতে নারী সম্পর্কিত বিচারে অধস্তন আদালতের সরাসরি হস্তক্ষেপ থাকা।
দেওয়ানি মামলাগুলো নিষ্পত্তি সাধনে সময় আরো কমিয়ে আনা।