আইন অঙ্গনে সমালোচনামূলক প্রথম ল জার্নাল

মানি লন্ডারিং: একটি বৈশ্বিক অপরাধ এবং এটি দমনে আইনগত কাঠামো


ভূমিকা

মানি লন্ডারিং একটি গুরুতর আর্থিক অপরাধ, যা অর্থনীতি ও বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। এটি অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের উৎস গোপন করে তা বৈধ আর্থিক ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া। যেমন: মাদক চোরাচালান, দুর্নীতি, কর ফাঁকি বা সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থকে বৈধ অর্থে রূপান্তর করা হয়।
এই অপরাধের প্রভাব ব্যাপক—এটি জাতীয় নিরাপত্তা, সুশাসন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে।

এই হুমকি মোকাবেলায়, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন করেছে।


মানি লন্ডারিং প্রক্রিয়ার ধারণা

মানি লন্ডারিং সাধারণত তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়:

  1. প্লেসমেন্ট (Placement): অবৈধ অর্থ আর্থিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করানো হয় (যেমন: ব্যাংকে জমা রাখা বা কিছু ক্রয় করা)।
  2. লেয়ারিং (Layering): সেই অর্থ বিভিন্ন জটিল লেনদেনের মাধ্যমে সরানো হয় যেন উৎস চিহ্নিত না করা যায়।
  3. ইন্টিগ্রেশন (Integration): লন্ডার করা অর্থ আবার বৈধ অর্থনীতিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, যেমন ব্যবসা বা বিনিয়োগের মাধ্যমে।

মানি লন্ডারিংয়ের প্রচলিত পদ্ধতিসমূহ

  • শেল কোম্পানির ব্যবহার
  • রিয়েল এস্টেট খাতে বিনিয়োগ
  • ট্রেড-ভিত্তিক মানি লন্ডারিং (ওভার বা আন্ডার ইনভয়েসিং)
  • অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট
  • ডিজিটাল ও ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে লেনদেন
  • স্ট্রাকচারিং বা স্মার্ফিং (বড় অঙ্কের অর্থকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করা)

মানি লন্ডারিংয়ের পরিণতি

  • আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা
  • সরকারের রাজস্ব হারানো
  • দুর্নীতি ও অপরাধ বৃদ্ধির হার
  • বিনিয়োগে বাধা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব
  • আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের সুনাম নষ্ট হওয়া

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তিসমূহ

  1. ফিনান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (FATF):
    এটি একটি আন্তঃসরকার সংস্থা যা মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন রোধে ৪০টি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নির্ধারণ করে। সদস্য দেশগুলোকে এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে হয়।
  2. জাতিসংঘের কনভেনশনসমূহ:
  • ভিয়েনা কনভেনশন (১৯৮৮): মাদক সম্পর্কিত মানি লন্ডারিং লক্ষ্য করে।
  • পালেরমো কনভেনশন (২০০০): সংগঠিত অপরাধ ও মানি লন্ডারিংয়ের বিস্তৃত রূপ মোকাবেলায় কার্যকর।
  1. ইউএসএ প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট (২০০১), যুক্তরাষ্ট্র:
    ব্যাংকিং খাতে AML ব্যবস্থা জোরদার করে এবং নজরদারি ও রিপোর্টিং প্রক্রিয়া শক্তিশালী করে।
  2. প্রসিডস অব ক্রাইম অ্যাক্ট (POCA), যুক্তরাজ্য:
    অপরাধলব্ধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত ও মানি লন্ডারিংকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে।
  3. ইউরোপীয় ইউনিয়নের AML নির্দেশনা (6AMLD):
    শাস্তির মাত্রা বাড়ানো ও অপরাধমূলক দায়বদ্ধতা প্রসারিত করে।

বাংলাদেশে মানি লন্ডারিং বিরোধী আইন ও ব্যবস্থা

  1. মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২:
    বাংলাদেশে AML আইনগত কাঠামোর মূল আইন। এর মূল বৈশিষ্ট্য:
  • মানি লন্ডারিংয়ের সংজ্ঞা ও অপরাধ ঘোষণা
  • তদন্তকারী সংস্থাগুলোর ক্ষমতা বৃদ্ধি
  • সম্পদ জব্দ, বাজেয়াপ্ত করার বিধান
  • আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও নির্দিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টিং বাধ্যবাধকতা
  1. সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯ (সংশোধিত):
    সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ করে, যা প্রায়শই মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
  2. বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU):
    বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতায় গঠিত। সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্ট (STR) ও নগদ লেনদেন রিপোর্ট (CTR) বিশ্লেষণ করে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে।
  3. মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাক্ট, ২০১২:
    বিদেশি দেশগুলোর সঙ্গে মানি লন্ডারিং ও আর্থিক অপরাধের তদন্তে সহযোগিতা প্রদান করে।
  4. দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭:
    যদিও এটি AML আইন নয়, তবে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ মানি লন্ডারিংয়ের উৎস হওয়ায় এটি AML প্রচেষ্টাকে সহায়তা করে।

বাংলাদেশে AML কমপ্লায়েন্সের বাধ্যবাধকতা

বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিম্নলিখিত নিয়ম অনুসরণ করতে হয়:

  • Know Your Customer (KYC)
  • Customer Due Diligence (CDD)
  • সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্ট (STR)
  • নগদ লেনদেন রিপোর্ট (CTR)
  • কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা

এইসব নিয়ম না মানলে শাস্তি, লাইসেন্স বাতিল, এমনকি ফৌজদারি মামলা হতে পারে।


উপসংহার

মানি লন্ডারিং একটি জটিল এবং ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক সমস্যা। বাংলাদেশসহ অনেক দেশ এর বিরুদ্ধে শক্তিশালী আইন এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তবে কার্যকর প্রতিরোধ নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন অব্যাহত নজরদারি, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব।

কমপ্লায়েন্স সিস্টেমকে শক্তিশালী করে, আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে এবং কঠোর শাস্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দেশগুলো তাদের অর্থনীতি রক্ষা করতে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *