আইন অঙ্গনে সমালোচনামূলক প্রথম ল জার্নাল

পুনরুদ্ধার ন্যায়বিচার ব্যবস্থায় কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের ব্যর্থতা

কিশোর অপরাধ একটি সামাজিক ব্যাধি। এই সমস্যাটি সব দেশের সব সমাজে দেখা যায়। আজকের সমাজে পিতামাতার উভয়ের ব্যস্ততা, পারিবারিক অশান্তি, স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছিন্নতা, যৌথ পরিবারের অনুপস্থিতি, মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি ইত্যাদি কিশোর অপরাধের সমস্যাটিকে আরও তীব্র করছে। শাস্তিমূলক বিচার ব্যবস্থা প্রায়শই এই জাতীয় আচরণ বা পালিত পুনর্বাসনের মূল কারণগুলো সমাধান করতে ব্যর্থ হয়। কিশোর অপরাধ দ্রুত বাড়ছে এবং এই সমস্যাটি এখন আমাদের চারপাশে খুব দৃশ্যমান। আবার কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রগুলো এমন একটি ভালো পরিবেশ সরবরাহ করে না যা তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সহায়তা করবে। 

উইকিপিডিয়ার ভাষ্যমতে, ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলায় টঙ্গীতে ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কিশোর আদালত, কিশোর হাজত এবং সংশোধন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে জাতীয় কিশোর অপরাধ সংশোধন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৭৮ সাল থেকে এ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালু হয়। বর্তমানে এর নাম জাতীয় কিশোর উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান। ২০১৩ সালের আইন শিশু আইনের সাথে সমন্বয় করে এর নাম পরিবর্তন করে জাতীয় শিশু উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান করা হয়।

শিশু আদালতে সাজাপ্রাপ্ত আইনে শিশুদের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রেরণ করা হয়।

শিশু কল্যাণ এবং অপরাধপ্রবণ শিশুদের সংশোধনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ শিশু আইন ১৯৭৪ প্রণীত হয়। শিশু আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল-

১৬ বছরের নিচের শিশু ও কিশোরদের অপরাধীদের বয়স্ক ও পেশাদার অপরাধীরদের থেকে আলাদা রেখে বিচার কার্য পরিচালনা করা।

যেভাবে আসে শিশুরা

১) শিশু আইন, ১৯৭৪ এর ৩২ ধারা অনুযায়ী দুঃস্থ, অবহেলিত, অভিভাবকহীন ও নির্যাতিত শিশু/কিশোরদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য আদালতের আদেশ অনুযায়ী।

২) শিশু আইন, ১৯৭৪ এর ৩৩ ধারা অনুযায়ী অনিয়ন্ত্রিত বা নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত শিশু/কিশোরকে পিতা-মাতা বা বৈধ অভিভাবক কর্তৃক কিশোর আদালতে মামলা করা ও আদালতের আদেশের মাধ্যমে।

৩) শিশু আইন, ১৯৭৪ এর ৫৫ ও ৫৬ ধারা অনুযায়ী বিভিন্ন আইনে পুলিশ কর্তৃক আটক হয়ে বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে বা মেয়াদপ্রাপ্ত সাজা হলে।

আমাদের দেশে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর দৈন্য দশা বিদ্যমান। এখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা সরবরাহ করা হয় না, যাতে একজন শিশু বা কিশোর তার মানসিক, শারীরিক ও নৈতিক উন্নতি ঘটাতে পারে। প্রায়ই সংবাদ মাধ্যমে অবহেলার চিহ্ন দেখা যায়। 

দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যায়, গাজীপুর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দি কিশোরদের চিকিৎসার জন্য বর্তমানে নেই কোনো চিকিৎসক। এখানকার বন্দিদের কেউ অসুস্থ হলে তাদের পাঠানো হয় টঙ্গী আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে ৫.৩৪ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত এ কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে সরকার অনুমোদিত বন্দি ধারণক্ষমতা ২০০। তবে সেখানে এখন ৭২৭ কিশোর বন্দি আছে। কিন্তু তাদের চিকিৎসায় নেই কোনো চিকিৎসক, কমপাউন্ডার বা নার্স। এই কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে চিকিৎসক না থাকায় কোনো বন্দি অসুস্থ হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। এখানে একজন কমপাউন্ডার ছিলেন। তিনি সম্প্রতি বদলি হয়েছেন। কমপাউন্ডার ও নার্সের পদ ২টি খালি আছে।

চিকিৎসা সেবা দিতে চিকিৎসক ও নার্সের পাশাপাশি এখানে আরও আবাসন ভবন প্রয়োজন। ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি কিশোর থাকে বলে নানা সুবিধা দেখা যাচ্ছে।

গত ২৮ জুন বিকেলে জামিনে মুক্তি পায় নারায়ণগঞ্জের রফিকুল ইসলামের ছেলে আল আমীন। রফিকুল ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমার ছেলে যে কক্ষে ছিল সেখানে একটি কক্ষে ১০ জন থাকত। ছেলেটা বলেছে যে জ্বর-ঠাণ্ডা হলে কোনো চিকিৎসা নেই। পানি খাওয়া যায় না। খাবার পানিতে দুর্গন্ধ। গোসলের পানি নোংরা। নোংরা পানিতে গোসল করে তার শরীরে ঘা হয়েছে। আমার ছেলের সঙ্গে আরও যারা জামিনে বের হয়েছে সবার শরীরে ঘা হয়েছে।’

গত ২৪ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টঙ্গী কিশোর উন্নয়নের বন্দি কিশোর রাকিবের মৃত্যু হয়। তার পরিবারের অভিযোগ, চিকিৎসা পেতে দেরি হওয়ায় রাকিব মারা গেছে।

বাংলাদেশের কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর করুণ দশা। একের পর এক অভিযোগ জমে জমে পাহাড় হয়ে গেছে। দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত এক নিবন্ধে দেখা যায় অনিয়মের ভয়াবহ পরিস্থিতি। সেখান বলা হয়েছে, টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে শিশু-কিশোররা মানবেতর জীবনযাপন করছে। এমনকি তাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যরাও অমানবিকভাবে বসবাস করছেন।

দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে— শিশু-কিশোরদের সংশোধনের বদলে দেশের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রগুলো যে অব্যবস্থাপনার নজিরে পরিণত হচ্ছে, তার প্রমাণ ওপরের ঘটনাগুলো। এসব কেন্দ্র থেকে প্রায়ই শিশু-কিশোরদের পালানো, মারধর, আত্মহত্যা, যৌন নির্যাতন, জবরদস্তি ও খুনখারাবির খবর আসে। এ নিয়ে লেখালেখি হয়, তদন্ত কমিটি হয়, কাউকে কাউকে বদলি করা হয়—তারপর সব আগের মতো। ফাঁকে জনবল ঘাটতির অজুহাত দেখিয়ে চাওয়া হয় আরও কর্মী নিয়োগের সুযোগ।

শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য রেডিও বিভাগে ‘মীনা পুরস্কার ২০১৫’ পেয়েছিলেন সাংবাদিক ফারহানা পারভিন। প্রশংসিত সেই প্রতিবেদনে তিনি কিশোর কেন্দ্র থেকে মুক্ত হয়ে আসা কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলেন।

এক শিশু তাকে বলেছিল, ‘ওখানে খেলার শিক্ষক আছে, সেলাই শেখানোর শিক্ষক আছে, কিন্তু আমার ভালো-মন্দের বিষয়টি বলার মতো কেউ নেই। আমি এমন একজনকে পাইনি যিনি আমাকে বলবেন, এইটা করো না, এটা ভালো না।’ আরেকটি শিশু অকপটে তাঁকে জানিয়েছিল ‘ওখানে অবহেলা অযত্ন আর ঘৃণার মধ্যে থাকতে থাকতে নিজের জীবনের ওপর বিতৃষ্ণা জন্মে। এই বিতৃষ্ণা থেকে জন্ম নেয় নিজেকে নিজে আঘাত করার প্রবণতা। অনেকে এভাবেই শান্তি খোঁজে।’

জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ নিজেদের উদ্যোগে সাময়িকভাবে যশোরসহ সব কটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রকল্পভিত্তিক কিছু জনবলের ব্যবস্থা করলেও মূল জনবল কাঠামোয় তাদের কোনো জায়গা নেই। এত দিনেও প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালন পদ্ধতি তৈরি হয়নি। শিশু পরিবার বা শিশুসদন নামে পরিচালিত এতিমখানাগুলো পরিচালনার লিখিত পদ্ধতি আর নিয়মকানুন থাকলেও শিশু উন্নয়নকেন্দ্রগুলো এখনো চলে ‘আগে এটা হয়েছে, আগে এটা হতো’ ধরনের রেফারেন্সে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *