আইন অঙ্গনে সমালোচনামূলক প্রথম ল জার্নাল

বাংলাদেশে গণবিচার: বর্তমান প্রেক্ষাপটে কারণ ও ব্যাখ্যা

ভূমিকা

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং আইনের শাসন দীর্ঘদিনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা, রাজনৈতিক সংঘাত ও নিরাপত্তা বাহিনীর জবাবদিহিতার অভাবের কারণে দেশে ‘গণবিচার’ বা extrajudicial killings তথা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো বেড়ে চলেছে। গণবিচার একটি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আইনের শাসনের পরিপন্থী। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা বাংলাদেশের এই পরিস্থিতির কারণ, বিস্তার, প্রভাব ও সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

গণবিচার কি?

গণবিচার বা extrajudicial killing হলো সরকার বা তার সংস্থা কিংবা সরকারের অনুমতি বা সহযোগিতায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা অন্য কোনো গোষ্ঠী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত, আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই কাউকে হত্যা করা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি অনেক সময় নিরাপত্তা বাহিনীর ক্রসফায়ার, ফায়ারিং বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া হিসেবে ধরা হয়। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই নির্দোষ মানুষই এর শিকার হন।

বাংলাদেশে গণবিচারের ইতিহাস ও বিস্তার

বাংলাদেশে গণবিচারের প্রেক্ষাপট বেশ পুরনো। দেশের স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনৈতিক সহিংসতা ও নিরাপত্তা বাহিনীর দুর্নীতি, অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে ২০০০-এর পর থেকে Rapid Action Battalion (RAB) নামে আধাসামরিক বাহিনী মাদক ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ‘ক্রসফায়ার’ বা বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা করেছে।

২০১৮ সালের পর মাদকবিরোধী অভিযান বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গণবিচারের ঘটনাও বেড়েছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন জেলায় শতাধিক মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘বন্দুকযুদ্ধে নিহত’ হয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক বিরোধী, মাদক ব্যবসায়ী, সাধারণ অপরাধী এবং অনেক সময় নিরীহ ব্যক্তিরাও এ হত্যার শিকার হয়।

২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনের সময়ও পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং বিভিন্ন গণবিচারের ঘটনা ঘটেছে। সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে শতাধিক ছাত্র নিহত হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর রিপোর্টে উঠে এসেছে।

গণবিচারের কারণসমূহ

১. রাজনৈতিক কারণে গণবিচার

বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধীদল একে অপরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বিরোধী দল ও আন্দোলনকারীদের দমন করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়। এর ফলে বিরোধীদের বিচারবহির্ভূত হত্যা বেড়ে যায়।

২. বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা অনেক সময় দীর্ঘ, জটিল ও দুর্বল। বিচার প্রক্রিয়ার ধীরগতির কারণে অপরাধীরা সহজেই রেহাই পায়। এতে সাধারণ মানুষ দ্রুত ন্যায়বিচার না পেয়ে ‘গণবিচার’ বা নিজেদের হাতে বিচার নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়।

৩. নিরাপত্তা বাহিনীর জবাবদিহিতার অভাব

নিরাপত্তা বাহিনীর অপব্যবহার এবং দুর্নীতির কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটে। অনেক সময় এই বাহিনী নিজেদের কর্মকাণ্ডের জন্য শাস্তি পায় না বা তদারকি নেই। এ কারণে তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করেন।

৪. অপরাধ দমন ও মাদকবিরোধী অভিযান

মাদক ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার নামে অনেক সময় নিরীহ মানুষও প্রাণ হারায়। নিরাপত্তা বাহিনী মাদক চোর, সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়, যেখানে ‘বন্দুকযুদ্ধে নিহত’ নামক গণবিচারের ঘটনাও ঘটে।

৫. সামাজিক অবিচার ও প্রতিশোধ

কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য গণবিচারের ঘটনাও ঘটে। এটি বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় বা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর দ্বারা বিরোধীদের বিরুদ্ধে হয়ে থাকে।

গণবিচারের প্রভাব

মানবাধিকার লঙ্ঘন

গণবিচার মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। এটি আইনের শাসনের মৌলিক নীতির পরিপন্থী এবং দেশের মানবাধিকার রেকর্ডকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হ্রাস

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হ্রাস পায়। এতে জনগণের মধ্যে আইন উপেক্ষার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা

গণবিচার রাজনীতিতে সহিংসতা বৃদ্ধি করে এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। বিরোধী দলগুলো নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ে।

আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত

বিচারবহির্ভূত হত্যার কারণে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের সরকারের সমালোচনা পেতে হয়। বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রসারিত হয়।

সামাজিক অবস্থা খারাপ হওয়া

গণবিচারের ফলে সমাজে ভয় ও অস্থিরতা ছড়ায়। জনগণ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য হয়।

প্রতিবিধান ও সমাধানের উদ্যোগ

নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কার

সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিরাপত্তা বাহিনীকে আরও বেশি জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। বাহিনীকে আইন মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে।

স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন

গণবিচারের ঘটনার স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করা জরুরি। এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার সহযোগিতায় হতে পারে।

আইনের সংস্কার

বিচার ব্যবস্থা দ্রুততর ও কার্যকর করতে আইনের সংস্কার করা দরকার। যাতে অপরাধীদের দ্রুত বিচার করা যায়।

জনসচেতনতা বৃদ্ধি

জনসাধারণকে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে, যাতে তারা নিজেদের হাতে বিচার না নিয়ে আইনের সাহায্য নেয়।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা

UN, Amnesty International, Human Rights Watch সহ আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা ও তদারকি বাড়াতে হবে।

সমাপনী মন্তব্য

বাংলাদেশে গণবিচারের ঘটনা বন্ধ করতে হলে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অঙ্গসংগঠনের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। নিরাপত্তা বাহিনীকে আইনগত ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। আইনের শাসন ও মানবাধিকার রক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। জনগণ যেন তাদের মৌলিক অধিকার পায়, সেজন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা জরুরি। দেশের স্থায়িত্ব ও গণতন্ত্রের উন্নতির জন্য এটি অপরিহার্য।

তথ্যসূত্র

1. Amnesty International Reports
 2. Human Rights Watch (HRW) Bangladesh Reports
 3. United Nations Human Rights Council (UNHRC) Documentation
 4. BenarNews Bangladesh Coverage
 5. Reuters Bangladesh Human Rights Reports
 6. Wikipedia: Rapid Action Battalion
 7. Times of India Reports on Bangladesh Minorities
 8. Freedom House Bangladesh Country Reports
 9. U.S. State Department Human Rights Reports
 10. Bangladesh Law Commission Publications.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *