আইন অঙ্গনে সমালোচনামূলক প্রথম ল জার্নাল

বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা: বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

ভূমিকা

 বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি, যা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বজায় রাখার জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের সংবিধানে এটি অন্যতম মৌলিক নীতি হিসেবে সংযোজিত হলেও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে এর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এই গবেষণাপত্রে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা, বাস্তবতা এবং বিদ্যমান চ্যালেঞ্জসমূহ বিশদভাবে আলোচনা করা হবে।

ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা ও সংবিধানিক স্বীকৃতি ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে সাধারণত রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড থেকে ধর্মকে পৃথক রাখার নীতিকে বোঝানো হয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতার স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছিল:

১. ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকবে।

2. রাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করবে না।

 3. সাম্প্রদায়িকতা দূর করা হবে।

তবে ১৯৭৭ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয় এবং ‘বিশ্বাসে ও নির্ভরশীলতায় সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি আস্থা’ সংযোজন করা হয়। পরবর্তীতে, ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পুনরায় ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে, সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহাল রাখা হয়, যা ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির সঙ্গে একটি বিতর্কিত দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে।

বাস্তবতা:

 ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োগ বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা আইনগতভাবে সংরক্ষিত হলেও বাস্তবে এর বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জপূর্ণ। কয়েকটি মূল বাস্তবতা নিচে আলোচনা করা হলো:

১. রাষ্ট্রধর্ম বনাম ধর্মনিরপেক্ষতা: সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ অংশের সাথে একটি সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মাঝে একটি নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি সৃষ্টি করে।

২. রাজনীতিতে ধর্মের ভূমিকা: বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলসমূহ প্রায়শই ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে। বিভিন্ন সময়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থান ও কার্যক্রম সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সাথে সাংঘর্ষিক।

৩. আইনি ও নীতিগত সমস্যা: সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত হলেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় কার্যকর আইন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর বিভিন্ন সময়ে সহিংসতা ও বৈষম্যমূলক আচরণের ঘটনা ঘটেছে।

৪. শিক্ষা ও সামাজিক প্রভাব: শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার প্রসার সীমিত। পাশাপাশি, ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো প্রায়শই ধর্মনিরপেক্ষতাকে আক্রমণ করে এবং সামাজিক বিভেদ সৃষ্টি করে।

★★★চ্যালেঞ্জসমূহ বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার কার্যকর বাস্তবায়নে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন:

১. সাংবিধানিক দ্বৈততা: একদিকে সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চিত করছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রধর্মের ধারণা বহাল রাখছে। এই বৈপরীত্য দূর করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

২. ধর্মভিত্তিক রাজনীতি: ধর্মীয় দল ও সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার ফলে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

৩. ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার: সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ এবং সহিংসতার ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

৪. ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সহিংসতা: উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোর উত্থান এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর প্রবণতা ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

৫. শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষতার অভাব: শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধকে আরো সুসংহত করা প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহনশীলতার চেতনায় গড়ে ওঠে।

★★★সমাধান ও সুপারিশ বাংলাদেশে কার্যকর ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার জন্য কয়েকটি সুপারিশ দেওয়া হলো:

১. সাংবিধানিক সংস্কার: রাষ্ট্রধর্মের ধারণাটি পুনর্বিবেচনা করে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ অংশের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করা দরকার।

২. ধর্মভিত্তিক রাজনীতির নিষিদ্ধকরণ: রাজনৈতিক দলগুলো যেন ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করতে পারে, সেজন্য কঠোর আইন প্রণয়ন প্রয়োজন।

৩. ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা: সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ আইন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নয়ন করা দরকার।

৪. ধর্মীয় সহিংসতা প্রতিরোধ: উগ্রপন্থী ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৫. শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি: শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহনশীলতা বিষয়ক পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ।

উপসংহার

বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার স্থান থাকলেও এর কার্যকর বাস্তবায়নে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও আইনি কাঠামোয় পরিবর্তন এনে, সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করে এবং ধর্মীয় উগ্রবাদ রোধের মাধ্যমে একটি সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা, সুশাসন এবং সচেতনতার প্রসার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *