ভূমিকা
সমুদ্র দূষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক সমস্যা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে, যা সামুদ্রিক পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং মানবস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। শিল্পায়ন, তেল ছড়িয়ে পড়া, প্লাস্টিক বর্জ্য এবং রাসায়নিক নিঃসরণের ফলে মহাসাগরগুলি ক্রমাগত দূষণের শিকার হচ্ছে। এর গুরুত্ব বিবেচনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিভিন্ন চুক্তি, কনভেনশন এবং সমঝোতার মাধ্যমে দূষণ মোকাবিলার জন্য আইনি কাঠামো গড়ে তুলেছে। এই প্রবন্ধে সমুদ্র দূষণ, এর উৎস, প্রভাব এবং এটি রোধে গৃহীত আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর বিশদ আলোচনা করা হলো।
সমুদ্র দূষণ কী?
সমুদ্র দূষণ হলো মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডের ফলে সমুদ্র ও মহাসাগরের দূষিত হওয়া, যা সামুদ্রিক জীবন ও পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর প্রধান উৎসগুলো হলো—
স্থলভিত্তিক দূষণ – শিল্পবর্জ্য, কৃষিজ রাসায়নিক ও পয়ঃনিষ্কাশনের ফলে সাগরে দূষণ ছড়ায়।
তেল ছড়িয়ে পড়া – তেলবাহী ট্যাঙ্কার দুর্ঘটনা, অফশোর ড্রিলিং এবং পাইপলাইনের লিকেজের মাধ্যমে সমুদ্রে তেল ছড়িয়ে পড়ে।
প্লাস্টিক দূষণ – একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক, পরিত্যক্ত মাছ ধরার জাল ও মাইক্রোপ্লাস্টিক সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
জাহাজ চলাচল ও সামুদ্রিক কার্যক্রম – জাহাজের বর্জ্য ফেলা, ব্যালাস্ট ওয়াটার নিঃসরণ এবং ধোঁয়া নির্গমন সামুদ্রিক দূষণের কারণ।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দূষণ – সমুদ্রের অম্লতা বৃদ্ধি ও উচ্চ তাপমাত্রা সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করছে।
সমুদ্র দূষণ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো
বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইনি দলিল প্রণীত হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—
১. জাতিসংঘের সমুদ্র আইন সংক্রান্ত কনভেনশন (UNCLOS), ১৯৮২
UNCLOS হলো সামুদ্রিক কার্যক্রম পরিচালনার প্রধান আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো। এটি রাষ্ট্রগুলোকে সমুদ্র দূষণ প্রতিরোধ, হ্রাস এবং নিয়ন্ত্রণে বাধ্য করে, বিশেষত স্থল, জাহাজ ও সমুদ্রতলের কার্যক্রম থেকে সৃষ্ট দূষণের ক্ষেত্রে।
২. জাহাজ থেকে দূষণ প্রতিরোধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশন (MARPOL), ১৯৭৩/৭৮
আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (IMO) কর্তৃক গৃহীত MARPOL চুক্তিটি জাহাজ থেকে সৃষ্ট সামুদ্রিক দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এটি ছয়টি সংযোজন (Annex) এর মাধ্যমে তেল, ক্ষতিকর রাসায়নিক, প্যাকেটজাত বিপজ্জনক পদার্থ, পয়ঃনিষ্কাশন, আবর্জনা এবং বায়ু দূষণের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে।
৩. লন্ডন কনভেনশন ও প্রোটোকল (১৯৭২, ১৯৯৬)
লন্ডন কনভেনশন সমুদ্রে বর্জ্য ও বিপজ্জনক পদার্থ ফেলার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। ১৯৯৬ সালের প্রোটোকলটি আরও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে এবং অনুমোদিত না হলে বর্জ্য ফেলা নিষিদ্ধ করে।
৪. বেজেল কনভেনশন (১৯৮৯)
এই কনভেনশনটি বিপজ্জনক বর্জ্যের আন্তর্জাতিক পরিবহন ও নিষ্পত্তি নিয়ন্ত্রণ করে যাতে সমুদ্রে বা অনুন্নত দেশে অবৈধভাবে বর্জ্য ফেলা না হয়।
৫. স্থায়ী জৈব দূষকের ওপর স্টকহোম কনভেনশন (২০০১)
এই চুক্তিটি দীর্ঘস্থায়ী বিষাক্ত রাসায়নিক, যেমন কীটনাশক ও শিল্পজাত দূষণ রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
৬. আঞ্চলিক চুক্তি ও কর্মপরিকল্পনা
বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক চুক্তি নির্দিষ্ট সামুদ্রিক পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য গৃহীত হয়েছে, যেমন—
OSPAR কনভেনশন (১৯৯২) – উত্তর-পূর্ব আটলান্টিক মহাসাগর সংরক্ষণে কার্যকর।
বার্সেলোনা কনভেনশন (১৯৭৬) – ভূমধ্যসাগরের পরিবেশ রক্ষায় গৃহীত।
কার্টাজেনা কনভেনশন (১৯৮৩) – ক্যারিবীয় অঞ্চলের সামুদ্রিক দূষণ মোকাবিলায় কার্যকর।
আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগের চ্যালেঞ্জসমূহ
যদিও শক্তিশালী আইনি কাঠামো বিদ্যমান, তবে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ কার্যকর বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করে, যেমন—
প্রয়োগের অভাব – অনেক উন্নয়নশীল দেশ পর্যাপ্ত সম্পদ ও প্রযুক্তির অভাবে এসব আইন কার্যকর করতে পারে না।
অবৈধ বর্জ্য ফেলা ও আইন লঙ্ঘন – কিছু শিল্প ও জাহাজ কোম্পানি দুর্বল নজরদারির সুযোগ নিয়ে পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে।
আইনি এখতিয়ার সম্পর্কিত দ্বন্দ্ব – জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে প্রয়োগে জটিলতা তৈরি হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন ও নতুন দূষণের চ্যালেঞ্জ – মাইক্রোপ্লাস্টিক, গভীর সমুদ্র খনন ও নতুন ধরনের রাসায়নিক দূষণ মোকাবিলার জন্য আইনের হালনাগাদ প্রয়োজন।
উপসংহার
সমুদ্র দূষণ বৈশ্বিক সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ, যা প্রতিরোধে শক্তিশালী আইনি কাঠামো, কার্যকর বাস্তবায়ন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। UNCLOS ও MARPOL-এর মতো চুক্তিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি তৈরি করলেও, আরও কার্যকর বাস্তবায়ন, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার এবং নতুন দূষণ সমস্যাগুলোর সমাধানে বিশ্বব্যাপী সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সমুদ্র রক্ষা করা কেবল আইনি বাধ্যবাধকতা নয়, বরং একটি নৈতিক দায়িত্বও বটে।