আইন অঙ্গনে সমালোচনামূলক প্রথম ল জার্নাল

বাংলাদেশে পণ প্রথা এবং এর প্রতিরোধমূলক আইনি ব্যবস্থা

*ভূমিকা* 

বাংলাদেশে পণ প্রথা একটি গভীরভাবে প্রোথিত সামাজিক রীতি যেখানে বরের পরিবারকে কনের পরিবার থেকে নগদ অর্থ, সম্পদ বা উপহার গ্রহণ করা হয়। যদিও এটি আইনগতভাবে নিষিদ্ধ, তবুও পণ প্রথা সমাজে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করছে, বিশেষত নারীদের ক্ষেত্রে। এই প্রবন্ধে বাংলাদেশে পণ প্রথার ঐতিহাসিক পটভূমি, এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব এবং এই প্রথা প্রতিরোধে গৃহীত আইনি ব্যবস্থাগুলো আলোচনা করা হবে। 

### *বাংলাদেশে পণ প্রথার ধারণা* 

বাংলাদেশে পণ প্রথা সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উভয় মাত্রায় বিদ্যমান। প্রথাগতভাবে, এটি কনের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রচলিত ছিল, তবে সময়ের সাথে এটি বরের পরিবারের দ্বারা জোরপূর্বক দাবি হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পণ সংক্রান্ত দাবি পূরণ না হলে নারীরা মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। *বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS)* এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২৭% বিবাহিত নারী কোনো না কোনোভাবে পণ সম্পর্কিত সহিংসতার শিকার হয়েছেন (BBS, ২০২০)। 

পণ প্রথা নারীদের শিক্ষা ও ক্ষমতায়নকে নিরুৎসাহিত করে এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে আরো দৃঢ় করে তোলে। এছাড়া, পণ প্রথা অনেক পরিবারের জন্য আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে এবং কন্যা সন্তানের জন্মকে অবমূল্যায়ন করে। 

### *বাংলাদেশে পণ প্রথা প্রতিরোধে আইনি কাঠামো* 

বাংলাদেশ সরকার পণ প্রথা রোধ এবং এই প্রথার কারণে সৃষ্ট সহিংসতা প্রতিরোধে বেশ কয়েকটি আইন প্রণয়ন করেছে। এর মধ্যে *পণ নিরোধ আইন, ১৯৮০* প্রধান ভূমিকা পালন করে। 

#### ১. *পণ নিরোধ আইন, ১৯৮০* 

এই আইনে পণ গ্রহণ, প্রদান বা দাবি করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আইনটির ৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী, পণ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ১ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। এই আইনে পণকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে—”বিবাহের শর্ত হিসাবে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে প্রদান বা গ্রহণযোগ্য যে কোনো সম্পদ বা মূল্যবান নিরাপত্তা” (পণ নিরোধ আইন ১৯৮০, ধারা ২)। 

আইনের ৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী, বিবাহের আগে, সময় বা পরে পণ দাবি করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। 

#### ২. *নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০* 

এই আইনে পণ সংক্রান্ত সহিংসতার বিরুদ্ধে বিশেষ সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে। আইনের ১১ নম্বর ধারা অনুসারে, পণ দাবির কারণে নারীদের মানসিক বা শারীরিক নির্যাতন করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে (নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, ধারা ১১)। 

#### ৩. *দণ্ডবিধি, ১৮৬০* 

বাংলাদেশের *দণ্ডবিধি, ১৮৬০*-এর ৩০৪বি এবং ৪৯৮এ ধারাগুলো পণ সংক্রান্ত অপরাধ মোকাবিলায় সহায়ক। ৩০৪বি ধারায় বলা হয়েছে, যদি বিবাহের সাত বছরের মধ্যে কোনো নারী অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মারা যায় এবং এটি পণ সংক্রান্ত হয়, তাহলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা নির্দিষ্ট মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হবে (দণ্ডবিধি ১৮৬০, ধারা ৩০৪বি)। 

#### ৪. *গার্হস্থ্য সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০* 

এই আইন গার্হস্থ্য সহিংসতার সব ধরনের অপরাধ, যার মধ্যে পণ সম্পর্কিত নির্যাতনও অন্তর্ভুক্ত, প্রতিরোধে সহায়ক। আইনটির ১০ নম্বর ধারা অনুসারে, ভুক্তভোগীরা সুরক্ষা আদেশ এবং আইনি সহায়তা পেতে পারেন (গার্হস্থ্য সহিংসতা আইন ২০১০, ধারা ১০)। 

### *আইন বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জসমূহ* 

যদিও পণ প্রতিরোধে আইন রয়েছে, তবুও এর কার্যকর বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সামাজিক লজ্জা, আইনি সচেতনতার অভাব এবং বিচার ব্যবস্থার ধীরগতি অনেক সময় ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে। এছাড়াও, সাংস্কৃতিকভাবে পণকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করার প্রবণতা আইনের কার্যকারিতা দুর্বল করে। 

### *আইনি ব্যবস্থার কার্যকারিতা বৃদ্ধির সুপারিশ* 

১. *আইন প্রয়োগের দক্ষতা বৃদ্ধি* – পণ সংক্রান্ত অভিযোগ পরিচালনার জন্য পুলিশ ও বিচার বিভাগের প্রশিক্ষণ জোরদার করা। 

২. *সচেতনতামূলক কার্যক্রম* – পণ প্রথার আইনি ফলাফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা। 

৩. *ভুক্তভোগীদের সহায়তা* – পণ নির্যাতনের শিকারদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র এবং আইনি সহায়তা ব্যবস্থা উন্নত করা। 

৪. *সামাজিক উদ্যোগ* – সমাজের ধর্মীয় ও সামাজিক নেতাদের পণ বিরোধী প্রচারণায় সম্পৃক্ত করা। 

### *উপসংহার* 

বাংলাদেশে পণ প্রথা একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা যা নারীর অধিকার লঙ্ঘন করে এবং লিঙ্গ বৈষম্যকে টিকিয়ে রাখে। যদিও পণ প্রতিরোধে কার্যকর আইন বিদ্যমান, এর সফল বাস্তবায়নের জন্য সমাজের মানসিকতার পরিবর্তন অপরিহার্য। সরকার, সিভিল সোসাইটি এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই বিধ্বংসী প্রথা নির্মূল করা সম্ভব। 

### *তথ্যসূত্র* 

– বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, নারীর প্রতি সহিংসতা সমীক্ষা (২০২০) 

– পণ নিরোধ আইন ১৯৮০, ধারা ২ 

– নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, ধারা ১১ 

– দণ্ডবিধি ১৮৬০, ধারা ৩০৪বি 

– গার্হস্থ্য সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০, ধারা ১০

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *