ভূমিকাঃ
প্রারম্ভিক বিবাহ, যেখানে একজন বা উভয় সঙ্গীর বয়স ১৮ বছরের কম, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা যা লক্ষ লক্ষ শিশুকে, বিশেষ করে মেয়েদের প্রভাবিত করে। এটি শিক্ষার ব্যাঘাত ঘটায়, অর্থনৈতিক সুযোগ সীমিত করে এবং গুরুতর আইনগত ও মানবাধিকার সংক্রান্ত উদ্বেগ তৈরি করে। যদিও অনেক দেশে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আইনগত ব্যবস্থা রয়েছে, দুর্বল বাস্তবায়নের ফলে এই সমস্যাটি অব্যাহত রয়েছে।
প্রারম্ভিক বিবাহের শিক্ষার উপর প্রভাবঃ
১. স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধিঃ
যেসব মেয়েরা অল্প বয়সে বিবাহিত হয়, তারা সাধারণত পড়াশোনা ছেড়ে দেয় এবং তাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। ইউনিসেফ (২০২১)-এর প্রতিবেদন অনুসারে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রায় ৩২% মেয়ে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বিয়ে করে, যা তাদের শিক্ষাজীবন বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ।
২. শিক্ষাগত অর্জনের ঘাটতিঃ
কম বয়সে বিয়ে হলে মাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করার সম্ভাবনা কমে যায়। বিশ্বব্যাংকের (২০২০) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাল্যবিবাহের কারণে মেয়েদের গড় শিক্ষাজীবন কমে যায়, যা ভবিষ্যতে তাদের উপার্জনক্ষমতা ও আর্থিক স্বাধীনতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
৩. কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগঃ
যথাযথ শিক্ষা ও দক্ষতার অভাবে প্রারম্ভিক বিবাহিত মেয়েরা চাকরির সুযোগ পায় না। এই নির্ভরশীলতা তাদের আর্থিকভাবে দুর্বল করে তোলে, ফলে তারা দারিদ্র্য ও শোষণের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে (Plan International, 2019)।
৪. মানসিক ও সামাজিক প্রভাবঃ
প্রারম্ভিক বিবাহ অনেক সময় মানসিক কষ্ট, পারিবারিক সহিংসতা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (২০২০)-এর গবেষণায় দেখা গেছে, অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া মেয়েরা প্রায়শই তাদের সহপাঠী ও শিক্ষাগত পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, যা তাদের ব্যক্তিগত বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে।
প্রারম্ভিক বিবাহ প্রতিরোধে আইনগত সুরক্ষাঃ
১. জাতীয় আইন ও নীতিমালাঃ
অনেক দেশে বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ নির্ধারণ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ অনুযায়ী, মেয়েদের ন্যূনতম বিবাহযোগ্য বয়স ১৮ এবং ছেলেদের ২১ বছর নির্ধারিত হয়েছে, যদিও কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রাখা হয়েছে (Bangladesh Law Commission, 2018)।
২. আন্তর্জাতিক চুক্তি ও নীতিমালাঃ
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ (CRC) শিশুদের বাল্যবিবাহ থেকে সুরক্ষিত রাখার পক্ষে মত প্রদান করে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) ৫.৩ ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ নির্মূল করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে (UN SDG Report, 2022)।
৩. আইন বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জঃ
- যদিও আইনগতভাবে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ, তবুও নিম্নলিখিত কারণে এটি অব্যাহত রয়েছে।
- সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত প্রভাব: অনেক সমাজে এখনও বিবাহকে শিক্ষার চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
- সচেতনতার অভাব: অনেক পরিবার বাল্যবিবাহের আইনি পরিণতি সম্পর্কে অবগত নয়।
- দুর্বল বাস্তবায়ন: প্রশাসনিক দুর্বলতা ও দুর্নীতির কারণে অনেক ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগ করা হয় না, ফলে বাল্যবিবাহ অব্যাহত থাকে।
প্রতিরোধমূলক কৌশল:
১. শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি:
সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলো মেয়েদের শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে বৃত্তি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে পারে। জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযান চালিয়ে বাল্যবিবাহের নেতিবাচক দিক তুলে ধরা যেতে পারে।
২. আইন প্রয়োগের কঠোরতা বৃদ্ধি:
বিয়ের আগে বয়স যাচাই নিশ্চিত করতে কঠোর নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। বাল্যবিবাহের আয়োজনকারীদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার।
৩. অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নকে উৎসাহিত করা:
মেয়েদের জন্য পেশাগত প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হলে তারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবে, যা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সহায়ক হবে।
নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো হলে তারা আর্থিকভাবে স্বাধীন হতে পারবে এবং বিবাহের ওপর নির্ভরতা কমবে।
উপসংহারঃ
প্রারম্ভিক বিবাহ শিক্ষার উপর গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং এটি মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। যদিও আইনগত সুরক্ষা রয়েছে, তবে কঠোর বাস্তবায়ন ও সামাজিক পরিবর্তন অপরিহার্য। শিক্ষা, আইন প্রয়োগ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই সমস্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। এভাবে শিশুদের অধিকার সংরক্ষণ করে তাদের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা যাবে।
তথ্যসূত্রঃ
1. UNICEF (2021). Child Marriage: Latest Trends and Challenges.
2. World Bank (2020). Ending Child Marriage: Progress and Prospects.
3. Plan International (2019). Girls’ Education and Child Marriage Prevention.
4. Bangladesh Law Commission (2018). Child Marriage Restraint Act, 2017.
5. Human Rights Watch (2020). Child Marriage and the Violation of Girls’ Rights.
6. UN SDG Report (2022). Sustainable Development Goals Progress Report.