আইন অঙ্গনে সমালোচনামূলক প্রথম ল জার্নাল

রাজশাহীতে হরিজন সম্প্রদায়: আইনিকাঠামো, চ্যালেঞ্জ এবং সংস্কারের পথসমূহ

ভূমিকা
বর্ণভিত্তিক বৈষম্য আজকের বিশ্বের অন্যতম গুরুতর সমস্যা। বাংলাদেশেও আমরা একই পরিস্থিতি দেখতে পাই। এখানে “নিম্ন বর্ণের” মানুষ, যাদের হরিজন বা দলিত বলা হয়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শোষিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত হয়ে আসছেন। বাংলাদেশে প্রধানত দুই ধরনের দলিত জনগোষ্ঠী দেখা যায়—একটি হলো বাঙালি দলিত, অন্যটি অ-বাঙালি দলিত। এখানে অনেক দলিত জনগোষ্ঠী বাস করেন যাদের “অস্পৃশ্য” মনে করা হয়, যেমন: চর্মকার, জেলে, পাতনী, কায়পুত্র, কালের, কুলে, কাহার ইত্যাদি। বাংলাদেশে হরিজনদের সাধারণত তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশার মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়—যেমন, ঝাড়ুদার, মৃতদেহ কাটার কাজ করা, ধোপা, লোহার কাজ, স্বর্ণকার, মুচি, তেল নিংড়ানোর কাজ ইত্যাদি। অতীতে ব্রিটিশরা এদেরকে মূলত ভারত থেকে এনে নিকৃষ্ট ও অপবিত্র কাজ যেমন পরিচ্ছন্নতা ও ঝাড়ুদারির জন্য নিযুক্ত করেছিল। আজও এদের একটি বড় অংশ বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশন ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে ঝাড়ুদার হিসেবে কাজ করেন।

রাজশাহীর হরিজন সম্প্রদায় একটি ঐতিহাসিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যারা দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের শিকার। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দলিত বা “অস্পৃশ্য” হিসেবে পরিচিত হরিজনরা মূলত পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে যুক্ত এবং শিক্ষালাভ, স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। যদিও বেশ কিছু আইনগত কাঠামো এদের অধিকার ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে গৃহীত হয়েছে, তবুও হরিজন সম্প্রদায় এখনও অনেক সমস্যার সম্মুখীন। এই প্রবন্ধে রাজশাহীর হরিজন সম্প্রদায়ের বর্তমান আইনি কাঠামো, তাদের মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ ও অর্থবহ সংস্কারের সম্ভাব্য পথসমূহ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।


হরিজনদের অধিকার সংক্রান্ত আইনগত কাঠামো

১. সংবিধানিক বিধানসমূহ: বাংলাদেশের সংবিধানে সমতা ও বৈষম্যহীনতার নীতি প্রতিস্থাপিত হয়েছে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিক সমান”, এবং ২৮ অনুচ্ছেদে ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া ২৯ অনুচ্ছেদে সরকারি চাকরিতে সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে।

২. আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি: বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সিভিল ও রাজনৈতিক অধিকার চুক্তি (ICCPR) এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি (ICESCR) সহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, যা বর্ণভিত্তিক বৈষম্য নির্মূল এবং হরিজনদের মতো সম্প্রদায়ের সমান অধিকার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেয়।

৩. পৌরসভা নিয়োগ নীতিমালা: রাজশাহীসহ বিভিন্ন পৌরসভায় হরিজনরা মূলত পরিচ্ছন্নতা ও ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিংয়ের কাজে নিযুক্ত। যদিও নিয়োগবিধিতে প্রকাশ্যে বৈষম্যমূলক ভাষা নেই, তথাপি অঘোষিত নীতিমালায় হরিজনদের নিম্নপদস্থ পেশার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়, যা সামাজিক কলঙ্ককে আরও পোক্ত করে।


রাজশাহীতে হরিজন সম্প্রদায়ের মুখোমুখি চ্যালেঞ্জসমূহ

১. পেশাগত ফাঁদে আবদ্ধতা: অধিকাংশ হরিজন পরিবার পরিচ্ছন্নতা ও ঝাড়ুদারির পেশা উত্তরাধিকারসূত্রে গ্রহণ করেন। শিক্ষার অভাব ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার সংকটের কারণে তারা অন্য পেশায় যেতে পারেন না। এমনকি যদি উপযুক্ত যোগ্যতা থাকেও, পূর্বধারণার কারণে তারা অন্য খাতে কাজ পান না।

২. সামাজিক বিচ্ছিন্নতা কলঙ্ক: হরিজনরা প্রায়শই আলাদা কলোনিতে বসবাস করেন, যেখানে বসবাসের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। তারা পরিচ্ছন্ন পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম থেকেও তারা বাদ পড়েন।

৩. শিক্ষাগত প্রতিবন্ধকতা: যদিও প্রাথমিক শিক্ষা সরকারিভাবে বিনামূল্যে, হরিজন শিশুদের স্কুলে বৈষম্য, অপমান এবং বুলিংয়ের শিকার হতে হয়। ফলে তাদের ঝরে পড়ার হার বেশি, শিক্ষার হার কম।

৪. আইনি অদৃশ্যতা: সংবিধানিক সুরক্ষা থাকলেও বাংলাদেশে বর্ণভিত্তিক বৈষম্য মোকাবেলায় নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। এই আইনি শূন্যতা হরিজনদের জন্য সুবিচার পাওয়া কঠিন করে তোলে।

৫. রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের অভাব: হরিজনরা স্থানীয় বা জাতীয় রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্যভাবে উপেক্ষিত। ফলে তাদের স্বার্থ ও দাবি নীতিনির্ধারণে প্রতিফলিত হয় না।

৬. সামাজিক অর্থনৈতিক প্রান্তিকতা: রাজশাহীর হরিজনদের অধিকাংশ এখনও ঐতিহ্যবাহী পেশা যেমন—ময়লা পরিষ্কার ও চর্মশিল্পে কাজ করেন। তাদের মধ্যে ভূমির মালিকানা নেই, ফলে তারা আরও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বাস করেন।

৭. বিচার ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার সীমিত: তারা প্রথাগত বিচারব্যবস্থা যেমন—পঞ্চায়েত বা সমাজ নির্ভর করে, যা পুরুষপ্রধান ও আনুষ্ঠানিক আইনগত স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত। ফলে পক্ষপাতদুষ্ট রায় হয় এবং নিরাপত্তাহীনতা বাড়ে।

৮. বৈষম্য সামাজিক বর্জন: হরিজনরা চাকরি, শিক্ষা, এবং সরকারি পরিষেবাসহ জীবনের বহু ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন। কখনো কখনো তাদেরকে শ্মশান বা অন্যান্য জনসাধারণের স্থানে প্রবেশ করতে না দেওয়া হয়, যা সমাজে প্রচলিত গভীর বৈষম্যের প্রতিচ্ছবি।


সংস্কারের পথসমূহ

১. বৈষম্যবিরোধী আইন প্রণয়ন: একটি নির্দিষ্ট আইন যা বর্ণভিত্তিক বৈষম্যকে স্বীকৃতি দেবে এবং তা দমন করবে, অত্যন্ত জরুরি। এতে শাস্তির বিধান ও শিক্ষায় ও কর্মসংস্থানে কোটা ব্যবস্থাসহ ইতিবাচক পদক্ষেপের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

২. অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা নীতি: শুধু শিক্ষা সেবা পৌঁছে দেওয়া নয়, সামাজিক কলঙ্কের বিরুদ্ধেও কাজ করতে হবে। বৃত্তি, মেন্টরশিপ, এবং বুলিংবিরোধী নীতি গ্রহণ করলে হরিজন শিক্ষার্থীদের সফলতা বাড়বে।

৩. জীবিকা বৈচিত্র্য দক্ষতা উন্নয়ন: প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও সরকারি-বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে কোটার ব্যবস্থা পেশাগত ফাঁদ ভাঙতে সাহায্য করবে। মাইক্রোক্রেডিট ও উদ্যোক্তা সহায়তা হরিজনদের নিজের উদ্যোগ গড়ে তুলতে সহায়তা করতে পারে।

৪. বাসস্থান জীবনের মানোন্নয়ন: হরিজন কলোনিগুলোতে উন্নত বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণে পরিচালিত উন্নয়ন মডেল এই সংস্কারকে কার্যকর করবে।

৫. প্রতিনিধিত্ব প্রচার: হরিজনদের নেতৃত্ব স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে উৎসাহিত করা দরকার। রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং নাগরিক সংগঠনগুলোর সহায়তা তাদের কণ্ঠস্বর নীতিনির্ধারণে তুলে ধরতে সাহায্য করবে।


উপসংহার
রাজশাহীর হরিজন সম্প্রদায় এখনও সমাজের প্রান্তে অবস্থান করছে, যেখানে তারা কাঠামোগত বাধা ও সামাজিক কুসংস্কারের শিকার। যদিও সংবিধানিক ও আইনগত কাঠামো সমতা প্রতিষ্ঠার ভিত্তি দেয়, বাস্তবিক প্রয়োগে তা অনেকটাই সীমিত। তাই একটি পূর্ণাঙ্গ ও অধিকারভিত্তিক পদ্ধতি গ্রহণ করা আবশ্যক—যার মধ্যে থাকবে আইনি সংস্কার, শিক্ষাগত ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি এবং জনগণনির্ভর প্রচার কার্যক্রম। কেবল তাহলেই রাজশাহী—এবং বৃহত্তর বাংলাদেশ—একটি সত্যিকার অর্থে সমতাভিত্তিক সমাজে রূপ নিতে পারবে, যেখানে হরিজনসহ প্রতিটি নাগরিকের মর্যাদা ও অধিকার পূর্ণভাবে স্বীকৃত ও বাস্তবায়িত হবে।

Reference:

  1. The Constitution of the People’s Republic of Bangladesh 1972, arts 27, 28, 29
  2. Local Government (City Corporation) Act 2009
  1. Bangladesh Dalit and Excluded Rights Movement (BDERM), Human Rights Situation of Dalits in Bangladesh: Shadow Report to the UN Human Rights Committee (BDERM 2017)
  2. Nagorik Uddyog and BDERM, Dalit Rights in Bangladesh: Advocacy Paper (2013)
  3. Human Rights Watch, ‘Cleaning Human Waste’: Manual Scavenging, Caste, and Discrimination in India (HRW 2014)
  4. Minority Rights Group International, Still Targeted: The Harijan Community in Bangladesh (MRG 2018)
  5. Bipul Sarder, ‘Socio-Economic Conditions of the Harijan Community in Northern Bangladesh’ (2020) 14(2) Bangladesh Journal of Public Administration 23
  6. Sumaiya Khair, ‘Legal Empowerment for the Poor and the Disadvantaged in Bangladesh: Strategies and Challenges’ (UNDP 2008)
  7. https://idsn.org/caste-discrimination/
  8. https://www.newagebd.net/article/95578/analysis-of-harijan-inclusivity-in-bangladesh

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *