আইন অঙ্গনে সমালোচনামূলক প্রথম ল জার্নাল

ভোক্তা অধিকার আইন ২০০৯ এর সমস্যা এবং সম্ভাবনা

ভূমিকা :- আইন তৈরি হয় দেশের সাধারণ জনগণের সামষ্টিক উন্নয়ন ও অধিকার নিশ্চয়ণের জন্য। আমাদের দেশে যদিও সঠিক ও সুপরিকল্পিত আইনের অনেক ঘাটতি রয়েছে তবুও এমন কিছু আইন এদেশে  রয়েছে যার বিশ্লেষণ ও নিপুণতা আইনজ্ঞদের সন্তুষ্ট করে। এদের মধ্যে একটি আইন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯। এই আইন  বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খল করার এবং সাধারণ জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রণীত একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন। এই আইনের মূল লক্ষ্য হলো ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ, প্রতারণা রোধ, খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের মান নিশ্চিত করা এবং ভোক্তাদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ প্রদান করা। তবে, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ থাকলেও, এই আইনের যথাযথ প্রয়োগ করলে দেশের অর্থনীতি ও জনগণের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।  

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর মূল বৈশিষ্ট্য:-  এই আইনের বিশ্লেষণ করলে আমরা চারটি প্রধাণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করতে পারি। বৈশিষ্ট্যগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো :-  

১. ভোক্তা অধিকার সম্পর্কিত  প্রয়োজনীয় শব্দকে  সংজ্ঞায়িত করা :এই আইনে ভোক্তার অধিকার সম্পর্কিত  প্রয়োজনীয় শব্দের সজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে।  যেমন এই আইনের ২ ধারায় মধ্যে বিক্রেতা কে, ভোক্তা কে এবং  ভোক্তার অধিকার বিরোধী কার্যক্রম কোনগুলো ইত্যাদি বিষয় সহ মোট ২২ টা বিষয়ের সজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। 

২. অবৈধ কার্যকলাপ নিষিদ্ধকরণ :নকল ও ভেজাল পণ্য বিক্রয়, ওজনে কম দেওয়া, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মিথ্যা প্রতারণা, খাদ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

৩. অভিযোগ দায়েরের ব্যবস্থা :যেকোনো ভোক্তা যদি প্রতারিত হন, তবে তিনি সরাসরি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর (DNCRP) বা আদালতে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন।

৪. জরিমানা শাস্তির ব্যবস্থা : আইন লঙ্ঘনের জন্য ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। মামলা দায়ের হলে সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড ও ২,০০,০০০/- টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।  

এই আইন কার্যকর হলে বাজার ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরে আসবে এবং সাধারণ মানুষ প্রতারণার শিকার হওয়া থেকে রক্ষা পাবে। তবে, এই আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে যা আইনটির কার্যকারিতা হ্রাস করছে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের প্রধান সমস্যা:-

. ভোক্তাদের সচেতনতার অভাব :বাংলাদেশের বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ এই আইনের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত নয়। ফলে তারা প্রতারণার শিকার হলেও আইনি সহায়তা নিতে অনীহা দেখায়। আবার অনেক মানুষ অভিযোগ করার প্রক্রিয়াকে দীর্ঘ ও ঝামেলাপূর্ণ মনে করে। ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অভিযোগ করার ঝামেলায় যেতে চান না।

. আইনের দুর্বল প্রয়োগ  নিম্নমানের জরিমানা এবং শাস্তি :অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাজারে ভেজাল ও নিম্নমানের পণ্য বিক্রি হচ্ছে, কিন্তু প্রশাসনের নজরদারি নেই। অনেক ব্যবসায়ী এই আইনের বিধান মানছে না, কারণ তারা জানে যে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে না। এছাড়াও  বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমাণ খুবই কম থাকে, যা বড় ব্যবসায়ীদের জন্য কোনো বড় শাস্তি হিসেবে কাজ করে না। ফলে তারা একই অপরাধ বারবার করেও পার পেয়ে যায়।

. দুর্নীতি প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপ : বাজার তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো অনেক সময় দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে না। ফলে অপরাধীরা শাস্তি এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়।

.বাজার পর্যবেক্ষণের অভাব :নিয়মিত বাজার মনিটরিং ও পণ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় নিম্নমানের ও ভেজাল পণ্য নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে দুর্নীতিবাজরা সুযোগ নেয়। 

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের সম্ভাবনা :-

যদি এই আইনটি যথাযথভাবে প্রয়োগ করা যায়, তাহলে বাংলাদেশে একটি নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।

. ভোক্তাদের অধিকতর সুরক্ষা নিশ্চিত করা : এই আইনের কার্যকর প্রয়োগ ভোক্তাদের অধিকার রক্ষা করবে এবং ব্যবসায়ীদের অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে বিরত রাখবে।যা দেশের সামষ্টিক উন্নয়নে সহায়তা করবে।  

. প্রতারণা কমবে মানসম্মত পণ্য নিশ্চিত হবে :আইনের কড়া প্রয়োগের মাধ্যমে খাদ্যসহ সকল পণ্যের মান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হবে। অপরাধীরা শাস্তি পেলে তাদের অপরাধ প্রবণতা কমবে। 

. ডিজিটাল অভিযোগ ব্যবস্থাপনা :বর্তমানে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে অভিযোগ দায়ের করা সম্ভব। এটি ভোক্তাদের জন্য সহজ ও দ্রুত সমস্যা সমাধানের সুযোগ তৈরি করেছে। এধরণের পদক্ষেপ দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে। 

. প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি হবে : যদি আইনের সঠিক প্রয়োগ হয়, তাহলে ব্যবসায়ীরা আরও সতর্ক হয়ে মানসম্মত পণ্য ও সেবা প্রদান করতে বাধ্য হবে। ফলে বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি হবে। মানসম্মত পণ্য ও পরিষেবা নিশ্চিত হলে দেশীয় পণ্যের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে, যা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য ভালো ফলাফল বয়ে আনবে।

. সরকারি বেসরকারি সংস্থার সমন্বয় :সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলো একসঙ্গে কাজ করলে এই আইনের কার্যকারিতা বহুগুণে বাড়তে পারে।

করণীয়:-

১.সচেতনতা বৃদ্ধি করা: প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যেন তারা প্রতারণার শিকার হলে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে।

২.আইনের কঠোর প্রয়োগ: সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর হতে হবে এবং নিয়মিত বাজার তদারকি করতে হবে।

৩.অনলাইন অভিযোগ ব্যবস্থা আরও সহজ করা: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে আরও সহজ ও কার্যকর করতে হবে, যাতে মানুষ সহজেই অভিযোগ দায়ের করতে পারে।

৪.জরিমানার পরিমাণ বৃদ্ধি: আইন লঙ্ঘনের শাস্তি আরও কঠোর করতে হবে, যাতে অপরাধীরা সহজে পার না পায়।

৫.সরকারিবেসরকারি সংস্থার সহযোগিতা: এনজিও ও বিভিন্ন ভোক্তা সংগঠনের সহায়তায় আইনটির বাস্তবায়ন আরও কার্যকর করা সম্ভব।

উপসংহার:- ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ বাংলাদেশের ভোক্তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন, যা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে বাজার ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনা সম্ভব। তবে, বর্তমানে এর বাস্তবায়নে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে, যা সমাধান করা জরুরি। আইনের কার্যকর প্রয়োগ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে, বাংলাদেশে একটি ন্যায্য ও নিরাপদ বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। সর্বোপরি, এই আইনের সফল বাস্তবায়নের জন্য শুধু সরকার নয়, ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে এবং নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জানতে হবে, যাতে তারা প্রয়োজনে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *