আইন অঙ্গনে সমালোচনামূলক প্রথম ল জার্নাল

বাল্যবিবাহের কারণ ও প্রতিকার: কেশবপুর থানা, যশোরের একটি আইনগত গবেষণা

বাল্যবিবাহের কারণসমূহ

১. দারিদ্র্য

দারিদ্র্য বাল্যবিবাহের অন্যতম প্রধান কারণ, বিশেষ করে কেশবপুর, যশোরের মতো গ্রামীণ এলাকায়। অনেক পরিবার দারিদ্র্যের কারণে সন্তানদের লালন-পালনে হিমশিম খায় এবং বাল্যবিবাহকে অর্থনৈতিক বোঝা কমানোর উপায় হিসেবে দেখে। কিছু ক্ষেত্রে, পিতামাতা কন্যার বিবাহের মাধ্যমে পণ গ্রহণ করে আর্থিক স্বস্তি লাভ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের কন্যাসন্তানদের শীঘ্রই বিয়ে দিতে বেশি আগ্রহী, কারণ তারা বিয়েকে আর্থিক নিরাপত্তার একটি মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে।

২. লিঙ্গ বৈষম্য

বিভিন্ন সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি বাল্যবিবাহের একটি বড় কারণ। মেয়েদের অনেক ক্ষেত্রেই ছেলেদের তুলনায় কম মূল্যায়ন করা হয় এবং তাদের প্রধান ভূমিকা গৃহিণী ও যত্নশীল ব্যক্তি হিসেবে ধরা হয়। এই সাংস্কৃতিক চিন্তাধারা মেয়েদের শিক্ষা ও পেশাগত সুযোগ সীমিত করে, ফলে বাল্যবিবাহ স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত হয়।

৩. শিক্ষার অভাব

শিক্ষা বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে বাংলাদেশের অনেক গ্রামীণ অঞ্চলে মেয়েদের শিক্ষালাভের সুযোগ সীমিত, যা অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা, সাংস্কৃতিক বিশ্বাস এবং অপর্যাপ্ত শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে ঘটে। যখন মেয়েরা স্কুলে যেতে পারে না, তখন তারা শৈশবে বিয়ের ঝুঁকিতে পড়ে।

৪. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি

ঐতিহ্যবাহী বিশ্বাস ও সামাজিক চাপ বাল্যবিবাহকে উৎসাহিত করে। কিছু সমাজে, মেয়েদের দ্রুত বিয়ে দেওয়াকে পারিবারিক সম্মান রক্ষার উপায় হিসেবে দেখা হয় এবং বিবাহপূর্ব সম্পর্ক প্রতিরোধের উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অনেক সংস্কৃতিতে মেয়েদের বয়ঃসন্ধির পরপরই বিয়ে হওয়া উচিত বলে মনে করা হয়, যা বাল্যবিবাহের চক্রকে চালু রাখে।

৫. আইনের দুর্বল প্রয়োগ

বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করার আইন থাকলেও, এর বাস্তবায়ন এখনও দুর্বল। দুর্নীতি, সচেতনতার অভাব এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার কারণে আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হয় না। অনেক পরিবারই আইন সম্পর্কে জানে না, অথবা তারা সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের কারণে আইন উপেক্ষা করে।

৬. নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ

নিরাপত্তাহীনতা এবং যৌন সহিংসতার আশঙ্কাও বাল্যবিবাহের একটি বড় কারণ। কিছু এলাকায়, পিতামাতারা তাদের কন্যাদের হয়রানি ও যৌন নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে অল্প বয়সেই তাদের বিয়ে দিয়ে দেয়। বিশেষ করে, সংঘাতপ্রবণ অঞ্চলে মেয়েরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে এবং তাদের বাল্যবিবাহের শিকার হতে হয়।

বাল্যবিবাহের পরিণতি

১. স্বাস্থ্য ঝুঁকি

অল্প বয়সে বিয়ের ফলে গর্ভধারণের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা মাতৃমৃত্যু এবং নবজাতকের মৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়ায়। ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের জন্য প্রসবকালীন জটিলতা, যেমন অবস্টেট্রিক ফিস্টুলা ও অপরিণত সন্তানের জন্ম, একটি বড় স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে। এছাড়া, তারা গার্হস্থ্য সহিংসতা ও যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে।

২. শিক্ষার প্রতিবন্ধকতা

বাল্যবিবাহ মেয়েদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত করে এবং তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সীমিত করে দেয়। বিবাহিত মেয়েরা সাধারণত পড়াশোনা ছেড়ে দেয়, ফলে তারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে না এবং সমাজে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে না।

৩. অর্থনৈতিক নির্ভরতা

যেসব মেয়েরা অল্প বয়সে বিয়ে করে, তারা সাধারণত চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় এবং স্বামীর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এর ফলে তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না এবং দারিদ্র্যের শিকার হয়।

৪. মানসিক প্রভাব

বাল্যবিবাহ মানসিক ও আবেগগত দিক থেকে গুরুতর প্রভাব ফেলে। অল্প বয়সে বিয়ের কারণে অনেক মেয়ে উদ্বেগ, হতাশা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়। সংসারের দায়িত্ব, পরিবারের চাপ, এবং শিক্ষাবঞ্চিত জীবন তাদের আত্মবিশ্বাস ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

আইনি কাঠামো ও প্রতিকার

১. আইনের কঠোর বাস্তবায়ন

বাংলাদেশের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ অনুসারে ১৮ বছরের নিচে বিয়ে নিষিদ্ধ। তবে, এর বাস্তবায়ন এখনো দুর্বল। কর্তৃপক্ষকে কঠোর নজরদারি ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কেউ আইন লঙ্ঘন করতে না পারে।

২. শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি

বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক এবং শিক্ষার উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। স্কুল, এনজিও এবং স্থানীয় সরকার একত্রে কাজ করে পরিবার ও সম্প্রদায়কে এ বিষয়ে শিক্ষিত করতে পারে।

৩. দরিদ্র পরিবারকে আর্থিক সহায়তা

পরিবারগুলোর আর্থিক অবস্থার উন্নতি করলে বাল্যবিবাহের হার হ্রাস পেতে পারে। কন্যাশিক্ষা বৃত্তি এবং অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করে পরিবারগুলোকে মেয়েদের পড়াশোনায় উৎসাহিত করা সম্ভব।

৪. সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করা

ধর্মীয় ও সামাজিক নেতাদের সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। তারা সমাজের মনোভাব পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন এবং মেয়েদের অধিকার রক্ষায় সহযোগিতা করতে পারেন।

৫. ভুক্তভোগীদের সহায়তা প্রদান

বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের জন্য কাউন্সেলিং ও আইনি সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। আশ্রয়কেন্দ্র এবং কারিগরি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করে তাদের নতুন করে জীবন শুরু করতে সাহায্য করা যেতে পারে।

উপসংহার

বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ এখনও একটি বড় সমস্যা, যা দারিদ্র্য, লিঙ্গ বৈষম্য, সামাজিক বিশ্বাস এবং আইনের দুর্বল বাস্তবায়নের কারণে টিকে আছে। এই সমস্যার সমাধানে একটি সমন্বিত পদ্ধতির প্রয়োজন, যেখানে আইন প্রয়োগ, শিক্ষা, অর্থনৈতিক সহায়তা এবং সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে পারি এবং শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *