সাইবার বুলিং বাংলাদেশে একটি উদীয়মান সমস্যা, যেখানে ইন্টারনেট ব্যবহার এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্রবৃদ্ধি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন মানুষ, বিশেষ করে তরুণেরা, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করতে শুরু করেছে, তেমনি সাইবার বুলিংয়ের ঘটনা বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। এই ঘটনাটি ভুক্তভোগীদের মানসিক ও আবেগগত প্রভাব ফেলতে পারে, যার ফলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি, আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং এমনকি আত্মহত্যার মতো দুঃখজনক পরিণতি হতে পারে। বাংলাদেশ এই সমস্যাটির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে এবং সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে কিছু আইনি কাঠামো গঠন করেছে। তবে এই আইনি প্রতিকারগুলি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
*বাংলাদেশে সাইবার বুলিং বুঝতে পারা*
সাইবার বুলিং হচ্ছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম যেমন সোশ্যাল মিডিয়া, ওয়েবসাইট এবং টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে অন্যদের হয়রানি, অপমান বা ভয় দেখানোর কাজ। বাংলাদেশে সাইবার বুলিংয়ের অধিকাংশ ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ঘটে, যেখানে বিশেষ করে কিশোর ও তরুণরা ব্যক্তিগত আক্রমণ, অনলাইন হুমকি, অপমানজনক বিষয়বস্তু এবং এমনকি পরিচয় চুরি সহ নানা ধরনের সমস্যা সম্মুখীন হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফেসবুক, টুইটার এবং ইনস্টাগ্রামের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলির বৃদ্ধি সাইবার বুলিংয়ের ঘটনা বাংলাদেশে বৃদ্ধি করেছে। ১৬০ মিলিয়নেরও বেশি জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অত্যন্ত বেড়ে গেছে, বিশেষত শহরাঞ্চলে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (BTRC) অনুযায়ী, দেশের ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ১০০ মিলিয়নেরও বেশি এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। যেমন যেমন মানুষ অনলাইনে যুক্ত হচ্ছে, তেমনি সোশ্যাল মিডিয়ার অন্ধকার দিক, বিশেষত সাইবার বুলিং, আরও স্পষ্ট হচ্ছে।
**বাংলাদেশে সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে আইনগত কাঠামো:
বাংলাদেশ সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কয়েকটি আইনি ও বিধানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, বিশেষত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (ICT) আইন ২০০৬ এবং এর পরবর্তী সংশোধনীর মাধ্যমে। যদিও ICT আইন মূলত সাইবার অপরাধের একটি ব্যাপক সমস্যা মোকাবেলা করে, তাতে সাইবার বুলিংয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিছু ধারা রয়েছে।
**ICT আইন ২০০৬ (২০১৩ সালে সংশোধিত):
ICT আইন ২০০৬ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহার সম্পর্কিত অপরাধ প্রতিরোধের জন্য প্রবর্তিত হয়েছিল। এই আইনে হয়রানি, মানহানি এবং সাইবার বুলিংয়ের অন্যান্য রূপের মোকাবিলার জন্য কিছু ধারার ব্যবস্থা রয়েছে। আইনের ধারা ৫৭ বিশেষভাবে অনলাইনে অপমানজনক, মানহানিকর বা ঘৃণা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে প্রকাশ বা প্রেরণ করা কনটেন্টকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে। এই ধারাটি সাইবার বুলিংয়ের মতো অপরাধের বিরুদ্ধে কার্যকর হলেও, এটি রাজনৈতিক মতপ্রকাশ দমনে ব্যবহৃত হতে পারে বলে সমালোচনা রয়েছে।
**ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন ২০১৮:
২০১৮ সালে বাংলাদেশ ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন (DSA) পাস করেছে, যা সাইবার অপরাধের উন্নত রূপের বিরুদ্ধে লড়াই করার উদ্দেশ্যে। এই আইনে সাইবার বুলিং এবং হয়রানির বিরুদ্ধে বিশেষ কিছু বিধান রয়েছে। আইনটির ধারা ২৫ এবং ২৯ অনলাইনে মানহানিকর, অপমানজনক বা মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করা, যা কোনো ব্যক্তির সম্মানহানি বা মানসিক ক্ষতি করতে পারে, তা অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে।
**দণ্ডবিধি ১৮৬:
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ধারা ৪৯৯ বাংলাদেশে মানহানির জন্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। এই ধারায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে মানহানি করার জন্যও শাস্তির বিধান রয়েছে।
**শিশু আইন ২০১৩:
২০১৩ সালের শিশু আইন শিশুদের প্রতি সকল ধরনের সহিংসতা, যার মধ্যে সাইবার বুলিংও রয়েছে, থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আরও কিছু বিধান প্রদান করে। এই আইনে কোনো শিশুদের ক্ষতি সাধনকারী যেকোনো ধরনের বুলিং, সাইবার বুলিং সহ, তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়।
*বাংলাদেশে সাইবার বুলিংয়ের চ্যালেঞ্জসমূহ:
আইনি কাঠামো থাকা সত্ত্বেও, সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে কিছু বড় চ্যালেঞ্জ হল:
**১. সচেতনতা এবং শিক্ষা সংকট:
সাইবার বুলিং সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাব এবং আইনি প্রতিকার সম্পর্কে অজ্ঞতা একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। অনেক ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবার আইনি সাহায্য পেতে জানেন না এবং অনেক সময় বুলিংকে তুচ্ছ বিষয় হিসেবে ধরা হয়।
*২. মামলার প্রতিবেদনের অভাব :
বাংলাদেশে অনেক সাইবার বুলিংয়ের ভুক্তভোগী তাদের অভিজ্ঞতা কর্তৃপক্ষকে জানাতে সাহস পান না, একদিকে প্রতিশোধের ভীতি এবং অন্যদিকে আইনি ব্যবস্থার প্রতি আস্থা কম থাকার কারণে।
*৩. আইনি প্রয়োগের দুর্বলতা:
আইনের কার্যকর প্রয়োগ বড় একটি চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি সাইবার অপরাধ সমাধানে দক্ষ নয় এবং প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞতার অভাব রয়েছে।
*৪. অস্পষ্ট আইনি সংজ্ঞা:
বর্তমান আইনে সাইবার বুলিংয়ের সঠিক সংজ্ঞা না থাকা এক বড় বাধা। আইনি দুর্বলতা ও অস্পষ্টতা অপরাধীদের দমন ও শাস্তির ক্ষেত্রে অসুবিধা তৈরি করে।
*৫. সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানির দায়বদ্ধতার অভাব:
অনেক সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে সাইবার বুলিং প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেই। এসব প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধে সঠিকভাবে অভিযোগ জানানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
উপসংহার:
সাইবার বুলিং বাংলাদেশে একটি গুরুতর এবং বৃদ্ধি পাওয়া সমস্যা যা জরুরি পদক্ষেপের দাবি করে। যদিও ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, ICT আইন এবং পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন রয়েছে, তবে প্রয়োগে কিছু দুর্বলতা রয়েছে। সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইনগত সংস্কার, শিক্ষা এবং সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের সহযোগিতায় একটি ব্যাপক উদ্যোগ প্রয়োজন। শুধুমাত্র এমন সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সাইবার বুলিংয়ের ক্ষতিকর প্রভাব কমানো সম্ভব হবে এবং অনলাইন স্পেসকে সবার জন্য নিরাপদ করা যাবে।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (BTRC)। “বাংলাদেশে ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা।” ফেব্রুয়ারি ২০২৫। https://www.btrc.gov.bd।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬। বাংলাদেশ সরকার।
ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, ২০১৮। বাংলাদেশ সরকার।
শিশু আইন, ২০১৩। বাংলাদেশ সরকার।
ইসলাম, এম. শাহিনুর। “বাংলাদেশে সাইবার বুলিং এবং অনলাইন হয়রানির প্রভাব।” সাইবার ক্রাইম স্টাডিজ জার্নাল ১২, নং ১ (২০২০): ৪৫-৬৭।
রহমান, মো. রাশেদুল। “বাংলাদেশে সাইবার বুলিংয়ের আইনি এবং সামাজিক চ্যালেঞ্জ: একটি সমালোচনামূলক পর্যালোচনা।” এশিয়ান জার্নাল অফ ল’ এন্ড সোসিয়াল সায়েন্সেস ১৮, নং ২ (২০২২): ১১৩-১৩০।