১. ভূমিকা
বাংলাদেশে শিশু বিবাহ একটি বড় সামাজিক সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে, যদিও এর প্রতিরোধের জন্য আইনি কাঠামো বিদ্যমান। এই সমস্যার সমাধানে সরকার ২০১৭ সালে শিশু বিবাহ প্রতিরোধ আইন ২০১৭ প্রণয়ন করে, যা ১৯২৯ সালের পুরনো আইনটি প্রতিস্থাপন করে। এই আইনটি শিশু বিবাহ নির্মূলের লক্ষ্য নিয়ে প্রণীত হলেও এতে এমন কিছু ফাঁক রয়েছে যা কার্যকর বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করে। এই প্রবন্ধে সেই আইনি ফাঁকগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং আইনটিকে শক্তিশালী করার জন্য কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
—
২. শিশু বিবাহ প্রতিরোধ আইন ২০১৭-এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ
শিশু বিবাহ প্রতিরোধ আইন ২০১৭-এ মেয়েদের জন্য বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ এবং ছেলেদের জন্য ২১ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। এই আইনে অভিভাবক, অভিভাবক প্রতিনিধি এবং বিয়ের রেজিস্ট্রারদের শাস্তির বিধান রয়েছে। আগের আইনের তুলনায় এতে কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে, যা শিশু বিবাহ প্রতিরোধের জন্য একটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করার কথা।
—
৩. শিশু বিবাহ প্রতিরোধ আইন ২০১৭-এর আইনি ফাঁকফোকর
৩.১ বিশেষ বিধান ধারা (ধারা ১৯):
আইনটির সবচেয়ে বড় ফাঁক হলো ধারা ১৯, যা “বিশেষ পরিস্থিতিতে” ন্যূনতম বয়সের শর্ত থেকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ দেয়। কিন্তু এই “বিশেষ পরিস্থিতি” কীভাবে সংজ্ঞায়িত হবে, তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি, ফলে এই ধারা অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করে।
৩.২ অন্যান্য আইনের সাথে অসামঞ্জস্য:
শিশু বিবাহ প্রতিরোধ আইন ২০১৭-এর সাথে বাংলাদেশের অন্যান্য প্রচলিত আইনের যেমন পেনাল কোড, যৌতুক প্রতিরোধ আইন, এবং মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের অসামঞ্জস্য রয়েছে। এই অসামঞ্জস্যতার কারণে আইন প্রয়োগ এবং ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি দেখা দেয়।
৩.৩ দুর্বল প্রয়োগ ব্যবস্থা:
আইনে কঠোর শাস্তির বিধান থাকলেও, তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়ে গেছে। স্থানীয় প্রশাসনের সক্ষমতা সীমিত, আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে, এবং বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় সামাজিক স্বীকৃতি থাকার ফলে এই আইন কার্যকর হয় না।
৩.৪ ভুক্তভোগীদের সুরক্ষার অভাব:
এই আইনে শিশু বিবাহের শিকার ভুক্তভোগীদের জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই, যেমন নিরাপদ আশ্রয়, আইনি সহায়তা, এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা। ফলে ভুক্তভোগীরা প্রায়শই আরও শোষণের শিকার হয়।
৩.৫ পর্যাপ্ত সচেতনতা ও পর্যবেক্ষণের অভাব:
আইনটি সম্পর্কে জনগণের মধ্যে, বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে, সচেতনতা সীমিত। তদুপরি, এই আইনের অধীনে কোনো কার্যকর পর্যবেক্ষণ বা প্রতিবেদন ব্যবস্থা নেই, যা মামলা সনাক্তকরণ এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে পারে।
—
৪. এই আইনকে শক্তিশালী করার প্রস্তাবসমূহ
৪.১ বিশেষ বিধান ধারা বাতিল বা পরিষ্কারকরণ:
অপব্যবহার রোধ করতে ধারা ১৯ হয় সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা উচিত বা স্পষ্ট নির্দেশিকা এবং বিচারিক তত্ত্বাবধানের অধীনে আনা উচিত, যাতে এই ধারার অপব্যবহার করে শিশু বিবাহকে বৈধতা দেওয়া না যায়।
৪.২ অন্যান্য আইনের সাথে সমন্বয়:
সরকারের উচিত শিশু বিবাহ প্রতিরোধ আইন ২০১৭-কে অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য একটি বিস্তৃত পর্যালোচনা করা, যাতে একটি সুসংগত আইনি কাঠামো তৈরি হয় এবং আইন প্রয়োগ সহজ হয়।
৪.৩ প্রয়োগ ব্যবস্থার শক্তিশালীকরণ:
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং স্থানীয় প্রশাসনের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তাদের প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ সরবরাহ করা জরুরি। বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে, যারা শিশু বিবাহের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করবে এবং দ্রুত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
৪.৪ ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা ও সহায়তা:
আইনে ভুক্তভোগীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়, আইনি সহায়তা, কাউন্সেলিং সেবা এবং পুনর্বাসন কর্মসূচির বিধান অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
৪.৫ জনসচেতনতা ও সামাজিক সম্পৃক্ততা:
সারাদেশে ব্যাপক জনসচেতনতা কর্মসূচি পরিচালনা করা উচিত, যা শিশু বিবাহের ক্ষতিকর প্রভাব এবং আইনগত পরিণতি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করবে। ধর্মীয় নেতা, শিক্ষক এবং সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রচেষ্টা চালানো যেতে পারে।
৪.৬ পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন ব্যবস্থা স্থাপন:
একটি শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন ব্যবস্থা চালু করা উচিত, যেখানে একটি জাতীয় ডাটাবেসের মাধ্যমে শিশু বিবাহের ঘটনা নিবন্ধন করা হবে। এটি কার্যকর বাস্তবায়ন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।
—
৫. উপসংহার
শিশু বিবাহ প্রতিরোধ আইন ২০১৭, শিশু বিবাহ রোধের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও, এর আইনি ফাঁক এবং দুর্বল বাস্তবায়নের কারণে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জিত হয়নি। এই ফাঁকগুলো চিহ্নিত করে, আইন সংশোধন, শক্তিশালী প্রয়োগ ব্যবস্থা, ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং কার্যকর পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশ শিশু বিবাহ নির্মূলে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করতে পারে এবং শিশুদের অধিকার রক্ষা করতে সক্ষম হবে।
—
৬. সূত্র
1. Bangladesh Child Marriage Restraint Act 2017.
2. UNICEF ,Ending Child Marriage: A Profile of Progress in Bangladesh.(2020)
3. Human Rights Watch, Marry Before Your House is Swept Away: Child Marriage in Bangladesh. (2015).
4. Ministry of Women and Children Affairs, Government of Bangladesh. (2021). National Plan of Action to End Child Marriage 2018-2030