আইন অঙ্গনে সমালোচনামূলক প্রথম ল জার্নাল

বাংলাদেশে লিঙ্গ সমতা এবং বৈষম্যের ক্ষেত্রে আইনী চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে লিঙ্গ সমতা ও বৈষম্য সংক্রান্ত আইনি চ্যালেঞ্জ:

লিঙ্গ সমতা

লিঙ্গ সমতা এমন একটি অবস্থা যেখানে সকল লিঙ্গের ব্যক্তিরা সমান অধিকার, দায়িত্ব এবং সুযোগ পান। এর অর্থ হলো একজন ব্যক্তি পুরুষ, নারী বা অন্য কোনো লিঙ্গ পরিচয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন কিনা, তার ওপর ভিত্তি করে তার অধিকার, দায়িত্ব বা সুযোগ নির্ধারিত হবে না। লিঙ্গ সমতার অন্তর্ভুক্ত বিষয়সমূহ:

•              সমান প্রবেশাধিকার: শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণে সমান সুযোগ।

•              সমান বেতন: সমান কাজের জন্য সমান পারিশ্রমিক, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।

•              স্টেরিওটাইপ থেকে মুক্তি: লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক ধ্যানধারণা ও প্রচলিত কুসংস্কার চ্যালেঞ্জ করা।

•              আইনি অধিকার: আইনের সমান প্রয়োগ এবং বৈষম্য ও সহিংসতা থেকে সুরক্ষা।

•              ক্ষমতায়ন: লিঙ্গভিত্তিক বাধা ছাড়াই পুরুষ ও নারীদের তাদের স্বপ্ন অনুসরণে উৎসাহিত করা।

লিঙ্গ বৈষম্য

লিঙ্গ বৈষম্য হলো লিঙ্গের ভিত্তিতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে অন্যদের তুলনায় অসম বা অন্যায্য আচরণের শিকার করা। এটি বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেতে পারে:

•              কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য: অসম বেতন, পদোন্নতিতে সীমাবদ্ধতা, অথবা লিঙ্গভিত্তিক হয়রানি।

•              শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈষম্য: নির্দিষ্ট লিঙ্গের জন্য শিক্ষা সুযোগ সীমিত রাখা।

•              আইনি বৈষম্য: এমন আইন বা ব্যবস্থা যা নির্দিষ্ট লিঙ্গকে অন্যদের তুলনায় বেশি সুবিধা দেয়, যেমন উত্তরাধিকার বা পারিবারিক আইন।

•              সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পক্ষপাত: লিঙ্গভিত্তিক সামাজিক ধ্যানধারণা, যেমন নারীদের শুধুমাত্র গৃহস্থালির কাজে নিয়োজিত হতে বলা বা পুরুষদের আবেগ প্রকাশ না করতে উৎসাহিত করা।

•              সহিংসতা ও হয়রানি: লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, যার মধ্যে গার্হস্থ্য নির্যাতন, যৌন হয়রানি এবং নারীদের প্রতি নিষ্ঠুর প্রথা যেমন নারী যৌনাঙ্গ বিকৃতি অন্তর্ভুক্ত।

লিঙ্গ সমতা ও বৈষম্য সম্পর্কিত আইন

বাংলাদেশ লিঙ্গ সমতা ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন আইন ও নীতি প্রণয়ন করেছে। এসব আইন সাংবিধানিক অধিকার, পারিবারিক বিষয়, কর্মক্ষেত্র সুরক্ষা এবং সহিংসতা প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করে। এর একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে দেওয়া হলো:

১. সাংবিধানিক বিধান

•              অনুচ্ছেদ ২৭: সকল নাগরিকের জন্য আইনের সামনে সমতার নিশ্চয়তা প্রদান করে।

•              অনুচ্ছেদ ২৮: ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্য নিষিদ্ধ করে এবং নারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের অনুমতি দেয়।

•              অনুচ্ছেদ ২৯: সরকারি চাকরিতে সমান সুযোগের পক্ষে কথা বলে এবং নারীদের মতো সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি দেয়।

২. লিঙ্গ সমতা ও বৈষম্য প্রতিরোধে মূল আইন

ক. পারিবারিক ও ব্যক্তিগত আইন

এই আইনগুলো ধর্মীয় ও প্রথাগত প্রভাব দ্বারা চালিত হয়, যা লিঙ্গ বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে:

•              মুসলিম পার্সোনাল ল (শরিয়ত) অ্যাপ্লিকেশন আইন ১৯৩৭: মুসলমানদের বিয়ে, তালাক, ভরণ-পোষণ ও উত্তরাধিকার নিয়ন্ত্রণ করে, যা নারীদের জন্য অসম উত্তরাধিকারের কারণ হতে পারে।

•              হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন ২০১২: হিন্দু বিবাহ নিবন্ধনকে অনুমোদন করে কিন্তু বাধ্যতামূলক নয়, ফলে নারীদের পূর্ণ আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত হয় না।

•              খ্রিস্টান বিবাহ আইন ১৮৭২ ও তালাক আইন ১৮৬৯: খ্রিস্টানদের জন্য বিবাহ ও তালাক নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে লিঙ্গভিত্তিক পক্ষপাতের সুযোগ রয়েছে।

খ. লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধের আইন

•              গার্হস্থ্য সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০: গার্হস্থ্য নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনি সুরক্ষা এবং সহায়তা পরিষেবা প্রদান করে।

•              নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০: ধর্ষণ, পাচার, যৌতুকজনিত সহিংসতা ও এসিড হামলার মতো অপরাধ মোকাবিলা করে।

•              এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০২ ও এসিড অপরাধ প্রতিরোধ আইন ২০০২: এসিড হামলা প্রতিরোধ ও এসিড বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করে।

গ. শ্রম ও কর্মসংস্থান সংক্রান্ত আইন

•              বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬: মাতৃত্বকালীন সুবিধা, বেতন বৈষম্য প্রতিরোধ এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিধান দেয়।

•              জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১: শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণে নারীর অধিকারকে উৎসাহিত করে।

৩. আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি

•              নারী নির্যাতনের সকল প্রকার বিলোপ সনদ (CEDAW): বাংলাদেশ এতে স্বাক্ষরকারী, তবে বিবাহ ও পারিবারিক জীবনের সমান অধিকারের বিষয়ে সংরক্ষণ রয়েছে।

•              টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDG) – লক্ষ্য ৫: লিঙ্গ সমতা: বাংলাদেশ লিঙ্গ সমতা অর্জনের জন্য কাজ করছে।

৪. বাস্তবায়ন ও কার্যকারিতা সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ

•              আইনি সচেতনতা: অনেক নারী তাদের আইনি অধিকার সম্পর্কে জানেন না।

•              বিচারিক পক্ষপাত: আইন প্রয়োগকারী ও বিচার বিভাগের পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ন্যায়বিচারে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

•              সম্পদের অভাব: নারীদের জন্য পর্যাপ্ত আইনি সহায়তা ও সহায়তা পরিষেবা অপ্রতুল।

সূত্র

•              বাংলাদেশের সংবিধান (অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮, ২৯)

•              বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (ILO ডাটাবেস)

•              গার্হস্থ্য সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ (বাংলাদেশ আইন মন্ত্রণালয়)

•              নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়)

•              জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ (MOWCA)

•              CEDAW (জাতিসংঘ)

•              SDG ৫: লিঙ্গ সমতা (UN SDG ওয়েবসাইট)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *