আইন অঙ্গনে সমালোচনামূলক প্রথম ল জার্নাল

বাংলাদেশে যৌন হয়রানি:আইনি দৃষ্টিভঙ্গি ও সুরক্ষা

ভূমিকা

বাংলাদেশে যৌন হয়রানি একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা, যা কর্মস্থল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জনসমাগমস্থল এবং এমনকি পরিবারেও ঘটে থাকে। আইনগত উন্নয়ন সত্ত্বেও, সামাজিক রীতিনীতি এবং ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার কারণে এই সমস্যা এখনও বিদ্যমান। এই প্রবন্ধে বাংলাদেশের যৌন হয়রানি সংক্রান্ত আইনি কাঠামো এবং ভুক্তভোগীদের জন্য উপলব্ধ সুরক্ষাগুলি বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

যৌন হয়রানির সংজ্ঞা ও ধরণ

যৌন হয়রানি বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেতে পারে, যেমন:

মৌখিক হয়রানি: অনভিপ্রেত মন্তব্য, অশ্লীল কৌতুক, বা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলা।

অ-মৌখিক হয়রানি: কুদৃষ্টি, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, বা অশালীন বার্তা পাঠানো।

শারীরিক হয়রানি: অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ, অশোভন আচরণ, বা যৌন নির্যাতন।

সাইবার হয়রানি: অনলাইন স্টকিং, অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করা, এবং কুরুচিপূর্ণ বার্তা প্রেরণ।

বাংলাদেশে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আইনি কাঠামো

১. দণ্ডবিধি, ১৮৬০

ধারা ৩৫৪: কোনো নারীর শালীনতাহানির উদ্দেশ্যে হামলা বা বলপ্রয়োগকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

ধারা ৫০৯: নারীর শালীনতাহানি করার উদ্দেশ্যে কথাবার্তা, অঙ্গভঙ্গি বা আচরণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

ধারা ৩৭৫ ও ৩৭৬: ধর্ষণের সংজ্ঞা প্রদান এবং কঠোর শাস্তির বিধান করা হয়েছে।

২. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০

এই আইনের আওতায় যৌন নির্যাতনের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে, যেখানে কিছু গুরুতর অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

৩. উচ্চ আদালতের নির্দেশিকা (২০০৯) যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে

BNWLA বনাম বাংলাদেশ (২০০৯) মামলায়, উচ্চ আদালত যৌন হয়রানির সংজ্ঞা প্রদান করে এবং সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে অভিযোগ গ্রহণের জন্য কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়।

নির্দিষ্ট আইন না থাকায় এই নির্দেশিকাগুলো বর্তমানে বাধ্যতামূলকভাবে কার্যকর।

৪. শ্রম আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮)

কর্মস্থলে হয়রানি-মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য নিয়োগকর্তাদের আইনগতভাবে বাধ্য করা হয়েছে।

নিয়োগকর্তাদের যৌন হয়রানির অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৫. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮

সাইবার হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এই আইনে অনলাইন মাধ্যমে যৌন হয়রানি, ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সুরক্ষা ও আইনি প্রতিকার

বাংলাদেশে যৌন হয়রানির শিকার ব্যক্তিরা নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার পেতে পারেন:

1. থানায় অভিযোগ দায়ের: দণ্ডবিধি বা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায় এফআইআর (FIR) দায়ের করা যায়।

2. কর্মস্থল অভিযোগ কমিটি: কর্মস্থল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি গঠনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

3. আইনি ব্যবস্থা: ভুক্তভোগীরা আদালতের মাধ্যমে তাদের অভিযোগ দায়ের করতে পারেন এবং BNWLA-এর মতো সংস্থাগুলোর কাছ থেকে আইনি সহায়তা পেতে পারেন।

4. সাইবার অপরাধ ইউনিট: অনলাইন হয়রানির শিকার হলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর অধীনে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেন্টারে অভিযোগ জানানো যেতে পারে।

5. নারী অধিকার সংস্থা: আইন ও সালিশ কেন্দ্র (ASK), নারীপক্ষ (Naripokkho)-এর মতো এনজিওগুলো আইনি সহায়তা ও পরামর্শ প্রদান করে।

বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জসমূহ

যদিও আইনি সুরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, কিছু চ্যালেঞ্জ এখনো বিদ্যমান:

সচেতনতাহীনতা: অনেক ভুক্তভোগী তাদের আইনগত অধিকার ও সুরক্ষা সম্পর্কে জানেন না।

সামাজিক কলঙ্ক: সামাজিক প্রতিক্রিয়ার ভয়ে অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ দায়ের করতে দ্বিধাগ্রস্ত হন।

বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা: আইনি প্রক্রিয়া ধীর হওয়ার কারণে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন।

প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা: অনেক কর্মস্থল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যৌন হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করে না।

উপসংহার

বাংলাদেশে যৌন হয়রানি একটি গুরুতর সমস্যা, তবে আইনগত সুরক্ষা কাঠামো এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি ভিত্তি তৈরি করেছে। বিদ্যমান আইনের কার্যকর প্রয়োগ, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নারী-বান্ধব নীতির প্রচার একটি নিরাপদ সমাজ গঠনের জন্য অপরিহার্য। কঠোর আইন বাস্তবায়ন এবং চলমান প্রচেষ্টার মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকারদের আরও ভালো সুরক্ষা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *