আইন অঙ্গনে সমালোচনামূলক প্রথম ল জার্নাল

বাংলাদেশে যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন:  কার্যকারিতা ও চ্যালেঞ্জ

‘Dowry’ শব্দটি সাধারণত সেই সম্পত্তিকে বোঝায়, যা নগদ অর্থ বা জিনিসপত্র আকারে কনে তার বিয়ের সময় সঙ্গে নিয়ে আসে।১৯৮০ সালের যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইনের ধারা ২ অনুযায়ী: 

যৌতুক বলতে বোঝায় ‘যেকোনো সম্পত্তি বা মূল্যবান নিরাপত্তা, যা বিয়ের সময় বা যেকোনো সময় সরাসরি বা পরোক্ষভাবে দেওয়া হয় বা দেওয়ার জন্য সম্মত হওয়া হয়: 

ক) বিয়ের এক পক্ষ থেকে অন্য পক্ষকে, অথবা 

খ) কনে বা বরের পিতামাতা বা অন্য কোনো ব্যক্তির দ্বারা বিয়ের যেকোনো এক পক্ষকে।’

ইসলামে যৌতুকের প্রথা স্বীকৃত নয়, এবং এ কারণে এটি বাংলাদেশের মুসলিম বিয়েতে অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে, বিয়ের সময় বা পরে যৌতুকের দাবি বা প্রদান গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে শহুরে জনগোষ্ঠীর তুলনায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে এটি প্রায় প্রতিটি বিয়ের চুক্তির একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। যৌতুক প্রদানের এই প্রথাটি হিন্দু বিয়ের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে, কারণ ঐতিহ্যবাহী হিন্দু আইনে কন্যাদের পিতামাতার সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়ার অধিকার স্বীকৃত নয়। ফলস্বরূপ, কন্যাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য যৌতুকের প্রথা ধীরে ধীরে বাংলাদেশের মুসলিম বিয়েতে প্রবেশ করে, বিশেষ করে ১৯৭০-এর দশকে।

বাংলাদেশের মুসলিম সমাজ হিন্দু প্রথা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে, যেহেতু ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলাদেশ ভারতীয় উপমহাদেশের অংশ ছিল। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে হিন্দু সমাজের সাথে যোগাযোগ ও মেলামেশার মাধ্যমে বিবাহ সংক্রান্ত লেনদেনে হিন্দু প্রথার প্রভাব স্পষ্ট, যার ফলে যৌতুকসহ বিভিন্ন প্রথা গৃহীত হয়েছে। যদিও প্রাচীন হিন্দু যুগে যৌতুক কনের উপকারের জন্য দেওয়া হত, বাংলাদেশের মুসলিম বিয়েতে এটি জোরপূর্বক ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কনের পরিবার থেকে টাকা আদায়ের একটি হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, যেখানে কন প্রকৃতপক্ষে কিছুই পায় না।

কোনও ক্ষেত্রে, যৌতুকের দাবি পূরণ করতে ব্যর্থ হলে নারীদের নির্যাতন, নিষ্ঠুর বা অমানবিক আচরণ এবং এমনকি হত্যার শিকার হতে হয়। বিয়ের পরও দীর্ঘ সময় ধরে যৌতুকের দাবি চলতে পারে, এবং তা পূরণ না করলে নারীদের পরিত্যাগ, তালাক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের হুমকি বা বাস্তব ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। কিছু ক্ষেত্রে, নারীরা যখন তাদের পিতামাতা বা অভিভাবকদের কাছ থেকে কোনো সহায়তার আশা দেখে না, তখন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

বাংলাদেশে যৌতুক সংক্রান্ত সহিংসতা বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় সংসদ ১৯৮০ সালে যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন প্রণয়ন করে। এই আইনে যৌতুক দাবি করা, গ্রহণ করা বা প্রদান করাকে একটি ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যার জন্য সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয়ই দেওয়ার বিধান রয়েছে।

**আইনি কাঠামো** 

বাংলাদেশ যৌতুক ও এর সাথে সম্পর্কিত অপরাধ নিষিদ্ধ করতে বেশ কয়েকটি আইন প্রণয়ন করেছে: 

– **যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন, ১৯৮০**: যৌতুক দেওয়া ও নেওয়া উভয়ই অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়, এবং এর জন্য জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। 

– **নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০**: যৌতুকের দাবির কারণে সৃষ্ট সহিংসতা মোকাবিলায় এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। 

– **দণ্ডবিধি, ১৮৬০**: যৌতুক সংক্রান্ত সহিংসতার কারণে ক্ষতি বা মৃত্যু ঘটলে শাস্তির বিধান রয়েছে। 

**যৌতুক আইনের কার্যকারিতা** 

কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে যৌতুক প্রথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এই আইনের কার্যকারিতার কিছু মূল দিক হলো: 

– **আইনি বিধান ও প্রয়োগ**: আইনে কঠোর শাস্তির বিধান থাকলেও সচেতনতার অভাব, দুর্নীতি এবং সামাজিক চাপের কারণে আইনের প্রয়োগ দুর্বল। 

– **বিচারিক প্রক্রিয়া**: দীর্ঘসূত্রতা ও সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ দায়ের করতে দ্বিধা করেন। 

– **সচেতনতা ও অভিযোগ দায়ের**: আইনি অধিকার সম্পর্কে সচেতনতার অভাবের কারণে অনেক নারী ন্যায়বিচার চাইতে পারেন না। এমনকি অভিযোগ দায়ের করা হলেও পরিবার বা সম্প্রদায়ের চাপে অনেক ক্ষেত্রে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। 

২০২৩ সালে দ্য ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদনে ঢাকার এক তরুণীর মর্মান্তিক ঘটনা উল্লেখ করা হয়, যিনি যৌতুকের দাবির কারণে বছরের পর বছর নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর আত্মহত্যা করেন। তার পরিবার যৌতুকের ক্রমবর্ধমান দাবি মেটাতে তাদের আর্থিক সম্পদ শেষ করে দিয়েছিল, কিন্তু নির্যাতন থামেনি। এই ধরনের ঘটনাগুলো আইনি সুরক্ষা থাকা সত্ত্বেও অনেক নারী যে কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হন, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

**নারী ভুক্তভোগীদের অবস্থান:** 

যৌতুক অপরাধ সামাজিকভাবে গঠিত এবং অত্যন্ত বিকৃত ঐতিহ্যবাহী প্রত্যাশার সাথে যুক্ত হতে পারে, যা নারীদের নিম্ন মর্যাদাকে জোরদার করতে কাজ করে। নারীদের মধ্যে এই ধরনের আচরণ মেনে নেওয়ার পাশাপাশি তা গোপন করার প্রবণতা লক্ষণীয়, যাতে পুরুষের অহংকার এবং পরিবারের সম্মান রক্ষা করা যায়। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে, একজন স্ত্রী তার স্বামীর দ্বারা নির্যাতনের কথা পুলিশে জানানোকে অদ্ভুত বলে মনে করা হয়। যদিও যৌতুকের অভিযোগ করার প্রায়োগিক প্রক্রিয়া বেশিরভাগ গ্রামবাসীর নাগালের বাইরে, নারীদের আদালতে যাওয়ার সবচেয়ে বড় বাধাগুলোর মধ্যে একটি হলো এই উপলব্ধি যে, যদি তারা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করে, তবে তাদের নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। তারা হয় অযৌক্তিক দাবি মেনে নেয় অথবা এই ধরনের সহিংসতা সহ্য করে এবং এটাকে তাদের ভাগ্য হিসেবে গ্রহণ করে। 

কিছু গবেষক দাবি করেন যে ‘আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা’ আইন প্রয়োগ না হওয়ার একটি কারণ। তবে, এই গবেষণায় দেখা গেছে যে বেশ কিছু উত্তরদাতা আইন সম্পর্কে ধারণা রাখেন, যা নিচের সারণীতে দেখানো হয়েছে: 

**যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন, ১৯৮০ সম্পর্কে জ্ঞান:** 

  •  
 ফ্রিকোয়েন্সিশতাংশ
আইনটি সম্পর্কে শুনেছেন২১৪২%
আইনের বিস্তারিত জানেন১০২০%
আইনটি সম্পর্কে জানেন না১৯৩৮%
মোট ৫০১০০%
  •  

**উল্লেখযোগ্য মামলার ইতিহাস** 

বাংলাদেশে যৌতুকের সমস্যা নিয়ে বেশ কিছু উচ্চ-প্রোফাইল মামলা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে: 

– **মাহমুদা আক্তার মামলা (২০১০)**: চট্টগ্রামের ২৪ বছর বয়সী মাহমুদাকে তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা পুড়িয়ে মারে, যখন তার পরিবার অতিরিক্ত যৌতুকের দাবি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। এই মামলাটি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয় এবং যৌতুক আইনের কঠোর প্রয়োগের দাবি জোরালো হয়। 

– **নারগিস বেগম মামলা (২০১৭)**: খুলনার একজন স্কুল শিক্ষিকা নারগিসকে তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বারবার যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন করে এবং পরে তার আঘাতের কারণে মৃত্যু হয়। আইনি প্রক্রিয়া চললেও মামলাটি বছরের পর বছর টেনে দেওয়া হয়, যা বিচারিক প্রক্রিয়ার ত্রুটিগুলো তুলে ধরে। 

– **রূপা হত্যা মামলা (২০২১)**: রাজশাহীর কলেজ ছাত্রী রূপাকে তার স্বামী বিষপ্রয়োগে হত্যা করে, যখন সে তার পরিবারকে অতিরিক্ত যৌতুকের টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দিতে অস্বীকার করে। এই মামলাটি জাতীয় ক্ষোভের জন্ম দেয়, এবং আসামীকে শেষ পর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত করা হয়, যা আইনি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। 

এই মামলাগুলো যৌতুকের বিরুদ্ধে কঠোর প্রয়োগ ব্যবস্থা এবং ভুক্তভোগীদের জন্য সহায়তা ব্যবস্থা জোরদার করার জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। 

**বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ** 

যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে: 

– **সাংস্কৃতিক ও সামাজিক নিয়ম**: যৌতুককে প্রায়ই একটি ঐতিহ্য হিসেবে দেখা হয়, অপরাধ হিসেবে নয়, যা এটি নির্মূল করা কঠিন করে তোলে। 

– **সঠিক মনিটরিংয়ের অভাব**: আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো প্রায়ই যৌতুক সংক্রান্ত অপরাধ প্রতিরোধে সক্রিয় ব্যবস্থা নেয় না। 

– **ভুক্তভোগীকে দোষারোপ ও সামাজিক চাপ**: ভুক্তভোগীরা প্রায়ই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়ে আইনি ব্যবস্থা নিতে অনিচ্ছুক হন। 

– **অর্থনৈতিক নির্ভরতা**: অনেক নারী তাদের স্বামীর উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল, যা তাদের যৌতুকের দাবি প্রতিরোধ করা কঠিন করে তোলে। 

**প্রস্তাবনা** 

বাংলাদেশে যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইনের কার্যকারিতা বাড়াতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি বিবেচনা করা যেতে পারে: 

– **আইন প্রয়োগ জোরদার করা**: নিবেদিত মনিটরিং ব্যবস্থার মাধ্যমে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা। 

– **আইনি সচেতনতা প্রচার**: যৌতুকের আইনি পরিণতি এবং ভুক্তভোগীদের জন্য উপলব্ধ সুরক্ষা সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানো। 

– **নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন**: যৌতুক-ভিত্তিক বিয়ের উপর নির্ভরতা কমাতে নারীদের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করা। 

– **সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ**: ধর্মীয় ও সম্প্রদায় নেতাদের সম্পৃক্ত করে যৌতুক সম্পর্কে সামাজিক ধারণা পরিবর্তন করা। 

– **দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া**: যৌতুক সংক্রান্ত মামলার জন্য ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্ট চালু করে সময়মতো ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। 

**উপসংহার** 

যদিও বাংলাদেশ যৌতুক নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে আইনগত অগ্রগতি অর্জন করেছে, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জগুলি এই আইনগুলির পূর্ণ বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে। যৌতুক নির্মূল এবং নারীর অধিকার সুরক্ষার জন্য আইনি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কৌশলগুলির সমন্বয়ে একটি বহুমুখী পদক্ষেপ প্রয়োজন। আইনের কঠোর প্রয়োগ, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নারীদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি যৌতুকমুক্ত সমাজ গঠনের পথ প্রশস্ত করা যেতে পারে। 

যৌতুক সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে কঠোর আইনি প্রয়োগ, সামাজিক পরিবর্তন এবং নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা একসাথে প্রয়োজন। এর আগ পর্যন্ত, অসংখ্য নারী নীরবে নির্যাতনের শিকার হতে থাকবেন, তাদের গল্প অকথিত থেকে যাবে এবং ন্যায়বিচার বঞ্চিত হবে। সাংবাদিক রাফিয়া আখতার যেমন দ্য বাংলাদেশ অবজার্ভারে লিখেছেন, “যৌতুকের বিরুদ্ধে লড়াই শুধু আইনের বিষয় নয়; এটি হৃদয় ও মন পরিবর্তনের বিষয়।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *