আইন অঙ্গনে সমালোচনামূলক প্রথম ল জার্নাল

বাংলাদেশে মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব: মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮-এর কার্যকারিতা ও সীমাবদ্ধতা

ভূমিকা

বাংলাদেশে মাদকাসক্তি একটি গুরুতর সামাজিক ও আইনগত সমস্যা, যা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদে মাদকের ব্যবহার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা রয়েছে। ক্রমবর্ধমান মাদক সমস্যা মোকাবিলায় সরকার ২০১৮ সালে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করে, যার লক্ষ্য ছিল মাদকাসক্তি ও মাদক পাচার প্রতিরোধ করা। এই প্রবন্ধে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮-এর কার্যকারিতা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

আইনি কাঠামো: মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮

মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ (NCA 2018) মাদকের বিরুদ্ধে আইনগত কাঠামোকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়। এটি ১৯৯০ সালের মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনকে বাতিল করে এবং কঠোর শাস্তি, উন্নত আইন প্রয়োগ প্রক্রিয়া এবং মাদকদ্রব্যের ব্যাপক সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করে। আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:

কঠোর শাস্তি: ২০০ গ্রাম বা তার বেশি হেরোইন, কোকেন বা ইয়াবার মতো মাদক উৎপাদন, বিতরণ বা পাচারে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

নিয়ন্ত্রিত মাদকের তালিকা সম্প্রসারণ: পূর্ববর্তী আইনে উল্লেখ না থাকা নতুন সিন্থেটিক মাদক অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

প্রিকিউরসার কেমিক্যালের নিয়ন্ত্রণ: মাদক তৈরিতে ব্যবহৃত রাসায়নিকের ব্যবহার ও বাণিজ্যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

সম্পদ বাজেয়াপ্ত ও অর্থপাচার প্রতিরোধ: মাদক পাচারের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

বাধ্যতামূলক পুনর্বাসন কর্মসূচি: শুধু শাস্তি নয়, মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮এর কার্যকারিতা

আইনটি প্রণয়নের পর বাংলাদেশের মাদক নিয়ন্ত্রণে কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে:

১. মাদক জব্দ ও গ্রেফতার বৃদ্ধি: আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার করেছে, যার ফলে মাদক জব্দ ও পাচারকারীদের গ্রেফতার বেড়েছে।

২. প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনগত শক্তিশালীকরণ: মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (DNC) কার্যক্রম জোরদার ও বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি পেয়েছে।

৩. জনসচেতনতা কার্যক্রম: সরকার ও বিভিন্ন এনজিও মাদকবিরোধী সচেতনতা কর্মসূচি পরিচালনা করছে।

৪. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে যৌথভাবে আন্তঃদেশীয় মাদক পাচার প্রতিরোধে কাজ করছে।

সীমাবদ্ধতা  চ্যালেঞ্জ

আইনের কঠোরতা সত্ত্বেও বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

১. আইন প্রয়োগে অতিরিক্ত নির্ভরতা: আইনটি মাদকের সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণ যেমন বেকারত্ব ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবিলায় খুব একটা কার্যকর নয়।

২. বিচারিক বিলম্ব ও দুর্নীতি: মামলার দীর্ঘসূত্রতা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে দুর্নীতির অভিযোগ আইনের বাস্তবায়ন দুর্বল করেছে।

৩. পুনর্বাসন কেন্দ্রের অভাব: আইনে পুনর্বাসনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হলেও, দেশে পর্যাপ্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র নেই এবং অনেক আসক্তই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পান না।

৪. মানবাধিকার উদ্বেগ: মৃত্যুদণ্ডসহ কঠোর শাস্তি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি তৈরি করেছে। কঠোর শাস্তি মাদক নিয়ন্ত্রণে কার্যকর নয় বলে অনেকে মনে করে এবং এটি বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো ঘটনাও বাড়িয়েছে।

৫. নতুন মাদকের হুমকি: নতুন প্রকারের মাদক (NPS) ও অনলাইন মাদক ব্যবসা, যা আইনটি যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে পারে না।

সংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ভবিষ্যৎ করণীয়

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদ জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে মাদক নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব তুলে ধরে। মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ সংবিধানের এই নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও, বাস্তবায়নে মানবাধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। কার্যকারিতা বাড়াতে নিচের সুপারিশগুলো প্রস্তাব করা হলো:

• পুনর্বাসন কর্মসূচি জোরদার: আরও চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।

• বিচারিক ও আইন প্রয়োগ সংস্থার সংস্কার: দুর্নীতি দমন ও বিচার প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে হবে।

• সমাজভিত্তিক প্রতিরোধ: স্থানীয় কমিউনিটিকে মাদক প্রতিরোধে সম্পৃক্ত করতে হবে। 

• নীতিমালার হালনাগাদ: সিন্থেটিক মাদক ও অনলাইন মাদক ব্যবসা প্রতিরোধে আইন আপডেট করতে হবে

• মানবাধিকার সম্মত প্রয়োগ: শাস্তির মাত্রা পর্যালোচনা ও যথাযথ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে।

উপসংহার

মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ বাংলাদেশে মাদকবিরোধী লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে বিচারিক বিলম্ব, মানবাধিকার উদ্বেগ ও নতুন মাদকের হুমকির কারণে এর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। সংবিধানের দায়বদ্ধতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে পুনর্বাসন, বিচারিক সংস্কার ও সমাজভিত্তিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি টেকসই ও কার্যকর মাদক নিয়ন্ত্রণ কৌশল গড়ে তোলা প্রয়োজন।

তথ্যসূত্র

• গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২, অনুচ্ছেদ ১৮(২)

• মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ (বাংলাদেশ)

• হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ‘বাংলাদেশ: মাদকবিরোধী অভিযানে বিচারবহির্ভূত হত্যা’ (২০১৯) https://www.hrw.org

• জাতিসংঘ মাদক ও অপরাধ দপ্তর, ‘বিশ্ব মাদক প্রতিবেদন ২০২৩’ (২০২৩) https://www.unodc.org

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *