আইন অঙ্গনে সমালোচনামূলক প্রথম ল জার্নাল

বাংলাদেশে পিতামাতার ভরণ-পোষণ: আইন ও প্রয়োগ

ভূমিকা:
‘ভরণ-পোষণ’ শব্দটি সাধারণত সমর্থন বা সহায়তা প্রদানের কার্যক্রমকে বোঝায়। পিতামাতার ভরণ-পোষণ বলতে তাদের বৃদ্ধ বয়সে সহায়তা প্রদানকে বোঝায়। পিতামাতার ভরণ-পোষণের মধ্যে চিকিৎসা সহায়তা, আর্থিক সহায়তা, গরম কাপড়, উৎসবের পোশাক ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এটি সন্তানদের নৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় দায়িত্ব যে তারা তাদের পিতামাতার ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করবে। পঞ্চাশ বছর বয়স অতিক্রম করার পর পিতামাতা সাধারণত তাদের সন্তানদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এ ধরনের ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের আইনগত ব্যবস্থায় কিছু সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যাতে যদি এমন পরিস্থিতি আসে যেখানে পিতামাতার জীবিকা নির্বাহের কোনো উপায় না থাকে, তাহলে তারা ভরণ-পোষণের আইনি অধিকার ব্যবহার করতে পারেন।

২০১৩ সালে, বাংলাদেশ সরকার পিতা-মাতা ভরণ-পোষণ আইন প্রণয়ন করেছে। এই আইনের অধীনে, পিতামাতারা তাদের বসবাসের স্থান নিয়ে অন্যায় হস্তক্ষেপ থেকে মুক্তি পাবেন এবং যদি তাদের সন্তানরা ভরণ-পোষণ দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ওই সন্তানদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পিতামাতার ভরণ-পোষণ সম্পর্কিত আইন

পিতামাতার ভরণ-পোষণের সাথে সম্পর্কিত কিছু নির্দিষ্ট আইন রয়েছে। এই বিষয়ে মূল আইন হল পিতামাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩। এই আইনে মোট নয়টি ধারা রয়েছে।

এই আইনের ধারা ০২ অনুসারে, ভরণ-পোষণ বলতে খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্যসেবা, বাসস্থান এবং সংশ্লিষ্ট সন্তানের দ্বারা প্রদান করা সঙ্গ অন্তর্ভুক্ত। এই সংজ্ঞার একটি ইতিবাচক দিক হলো, এটি সন্তানের মানসিক সমর্থন বা সঙ্গদানকেও ভরণ-পোষণের অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই আইন অনুযায়ী সন্তানদের জন্য পিতামাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে, এই আইনে পিতামাতার সম্পত্তি শিশু, নাতি-নাতনি বা অন্যদের দ্বারা অপব্যবহার থেকে রক্ষা করার বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই।

এই আইনের বিধান অনুসারে, পিতামাতা তাদের সন্তানদের বিরুদ্ধে মামলা করে ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করতে পারেন। কিন্তু তারা তাদের সন্তানদের সম্পত্তি জোরপূর্বক হস্তান্তর করা বা আবেগের মাধ্যমে সম্পত্তি নেয়ার হাত থেকে বিরত রাখতে পারেন না। যদি কোনো সন্তান যথাযথ ভরণ-পোষণ প্রদান না করে বা যথাযথ কারণ ছাড়া পিতামাতাকে বৃদ্ধাশ্রম বা অন্য কোথাও থাকতে বাধ্য করে, তবে পিতামাতা সন্তানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন।

এই আইন অনুসারে, যদি কোনো পিতামাতার একাধিক সন্তান জীবিত থাকে, তাহলে তারা পরামর্শ করে পিতামাতার ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করবে। এটি সন্তানের উপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করে যে, তারা পিতামাতার সাথে বসবাস করবে এবং তাদের চিকিৎসা ও পরিচর্যা নিশ্চিত করবে। আমাদের সমাজে সাধারণত দেখা যায় যে, অনেক সন্তান তাদের বৃদ্ধ পিতামাতাকে অবহেলা করে। এই অনৈতিক আচরণ রোধ করার জন্য এই আইনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোনো সন্তানই তাদের পিতামাতাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অন্য কোথাও থাকতে বাধ্য করতে পারবে না।

ধারা ০৪ অনুযায়ী, যদি পিতামাতা অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে প্রতিটি সন্তানের দায়িত্ব থাকবে তাদের দাদা-দাদী বা নানী-নানার ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা।

ধারা ০৫ অনুযায়ী, যদি কোনো সন্তান এই বিধান লঙ্ঘন করে, তবে তাকে অনধিক ১,০০,০০০ টাকা (বাংলাদেশি টাকা) জরিমানা বা অনধিক তিন মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। যদি কেউ সন্তানের বিরুদ্ধে পিতামাতার ভরণ-পোষণ না দেয়ার জন্য প্ররোচিত করে, তবে তাকেও একই শাস্তি দেওয়া হবে।

ধারা ০৬ অনুসারে, এই আইনের অধীনে করা অপরাধসমূহ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য এবং আপসযোগ্য। মামলাগুলো প্রথম শ্রেণির বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট বা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা পরিচালিত হবে। তবে, এই আইনের অধীনে আদালত পিতামাতার লিখিত অভিযোগ ছাড়া কোনো মামলা গ্রহণ করতে পারবে না।

এই আইনে বিচারের বিকল্প পদ্ধতিরও ব্যবস্থা রয়েছে। আদালত পিতামাতার অভিযোগ ও অভিযুক্ত সন্তানদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির কাছে পাঠাতে পারে। তবে, এই ধরনের সমাধানের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষকে শুনানির সুযোগ দেওয়া হবে।

ধারা ০৮ অনুসারে, এই ধরনের শুনানিতে গৃহীত যে কোনো সিদ্ধান্তকে আদালতের চূড়ান্ত রায়ের সমান বলে গণ্য করা হবে।

ধারা ০৯ অনুসারে, সরকার প্রয়োজনে এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য বিধি প্রণয়ন করতে পারবে।

এছাড়া, পিতামাতার ভরণ-পোষণের বিষয়ে অন্যান্য কিছু আইনও রয়েছে, যেমন:

বাংলাদেশের সংবিধান

পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩

দণ্ডবিধির ১২৫(১)(ডি) ধারা

মুসলিম পারিবারিক আইন

বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫(ডি) অনুসারে বয়স্কদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে।

২০১৩ সালের পিতামাতার ভরণ-পোষণ আইন প্রণয়নের আগে, বাংলাদেশে পিতামাতার ভরণ-পোষণের ব্যর্থতার জন্য সন্তানদের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো আইন ছিল না। পিতামাতা শুধুমাত্র পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩-এর ধারা ৫(ডি) অনুযায়ী মামলা করতে পারতেন।

সুতরাং, উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, ২০১৩ সালের পিতামাতার ভরণ-পোষণ আইন হল পিতামাতার ভরণ-পোষণের মূল আইন। পাশাপাশি, বাংলাদেশে বিদ্যমান অন্যান্য আইনও পিতামাতার ভরণ-পোষণের বিষয়ে কিছু বিধান প্রদান করে। তবে, বর্তমানে প্রচলিত মূল আইন হল পিতামাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩।

বর্তমান পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশে পিতামাতার ভরণ-পোষণ আইন এর প্রয়োগ:

আমরা প্রায়ই দেখি যে অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের থেকে আলাদা বসবাস করেন কারণ তাদের সন্তান তাদের সাথে থাকতে চায় না এবং তাদের ভরণ-পোষণ দিতে চায় না। অনেক বাবা-মাকে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে হয় কারণ তাদের সন্তানরা তাদের ভরণ-পোষণ দিতে অস্বীকার করে। সন্তানদের কাছ থেকে ভরণ-পোষণ না পেয়ে, অনেক বাবা-মা নিরুপায় হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করতে বাধ্য হন। প্রতিদিন আমরা পত্রিকা, টেলিভিশন, ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন সংবাদ পাই যে সন্তানরা তাদের বাবা-মাকে ভরণ-পোষণ থেকে বঞ্চিত করছে এবং স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা বসবাস করছে। তারা বাবা-মায়ের ভরণ-পোষণের ব্যাপারে কোনো চিন্তা করে না।

আমরা প্রায়ই সংবাদে দেখতে পাই যে সন্তানরা বাবা-মাকে হত্যা পর্যন্ত করছে শুধুমাত্র ভরণ-পোষণের দায়িত্ব এড়ানোর জন্য। প্রতিনিয়ত এমন খবর আসে যে সন্তানরা বাবা-মায়ের ভরণ-পোষণ বন্ধ করে দিয়েছে এবং তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে দিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা বাবা-মায়েরা অত্যন্ত দুর্বিষহ জীবন যাপন করেন। তারা সুস্থ ও নিরাপদ জীবন যাপন করতে পারেন না।

প্রতিটি সমাজেই মূলত বয়স্ক ব্যক্তিরা সবচেয়ে বেশি অসহায়। বাংলাদেশেও, অন্যান্য দেশের মতো, বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক প্রমাণ রয়েছে যে পরিবারগুলো বিভিন্নভাবে এই প্রবীণ ব্যক্তিদের অবহেলা করছে, এমনকি তাদের প্রতি ন্যূনতম মানবিক আচরণও করা হচ্ছে না। বাংলাদেশের সংবিধান এবং প্রবীণদের ভরণ-পোষণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্য রেখে, সরকার ২০১৩ সালে “পিতামাতার ভরণ-পোষণ আইন” প্রণয়ন করেছে।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, বেশিরভাগ বাবা-মা এবং সন্তানরা এই আইনের সাথে পরিচিত নয়। ফলে, তারা অবিরত এই আইনের লঙ্ঘন করছে। এই আইনের বিধান অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের অবশ্যই তাদের বয়স্ক পিতামাতার ভরণ-পোষণ দিতে হবে। এই আইন অনুযায়ী, বাবা-মা তাদের সন্তানদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন যদি তারা ভরণ-পোষণ না দেয়। যদিও এই আইন বাবা-মায়ের ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে, বাস্তবে আমরা দেখি যে সন্তানরা প্রায়ই এই দায়িত্ব এড়িয়ে যায়।

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ বাবা-মা দরিদ্র এবং নিরক্ষর। তারা আইন সম্পর্কে সচেতন নয়। তারা জানেই না যে বৃদ্ধ বয়সে সন্তানদের কাছ থেকে ভরণ-পোষণ পাওয়া তাদের অধিকার। আইনে পিতামাতার ভরণ-পোষণের জন্য বিভিন্ন ধরণের বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই বিধানগুলোর প্রয়োগ খুবই দুর্বল, যার মূল কারণ হলো অশিক্ষা, অসচেতনতা ইত্যাদি। এমনকি যারা আইন সম্পর্কে জানেন, তারা নিজেদের সন্তানদের বিরুদ্ধে মামলা করতে চান না কারণ তারা সন্তানদের প্রতি অগাধ ভালোবাসা অনুভব করেন এবং কোনো ঝামেলায় জড়াতে চান না।

উপরে আলোচিত বিষয়গুলো থেকে আমরা বলতে পারি যে, বর্তমানে বাংলাদেশে “পিতামাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩” বিদ্যমান। তবে এই আইন থাকা সত্ত্বেও, অনেক সন্তান তাদের বাবা-মার ভরণ-পোষণ দিতে অস্বীকার করে এবং তাদের অবহেলিত অবস্থায় ফেলে রাখে।

ফাঁকফোকরসমূহ:

১. পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, “পিতা” ও “মাতা” বলতে শুধুমাত্র জৈবিক বাবা-মাকে বোঝানো হয়েছে, যা সৎ বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিনা তা স্পষ্ট নয়। এই আইন বৃদ্ধ ব্যক্তিদের ও দাদা-দাদী/নানা-নানীদের কথা বলে, যাদের সন্তান রয়েছে। তবে যাদের সন্তান নেই, তাদের বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই।

২. আইন অনুযায়ী, যদি বাবা-মা সন্তানদের সাথে না থাকেন, তবে প্রতিটি সন্তানকে তার আয়ের একটি যুক্তিসঙ্গত অংশ প্রদান করতে হবে। প্রতিটি যুবককে তার মাসিক আয়ের ১০ শতাংশ বাবা-মায়ের ভরণ-পোষণের জন্য দিতে হবে। তবে এখানে ভরণ-পোষণের নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারণ নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে।

৩. পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, শুধুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত পিতামাতা নিজেরা অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। অন্য কেউ তাদের পক্ষে মামলা করতে পারবেন না। অনেক সময় বাবা-মা নিরক্ষর বা শারীরিকভাবে অক্ষম হওয়ায় অভিযোগ করতে পারেন না। ফলে বাংলাদেশে অধিকাংশ বাবা-মা তাদের সন্তানদের কাছ থেকে ভরণ-পোষণ পাচ্ছেন না, কিন্তু আদালতে কোনো মামলা দায়ের করছেন না।

৪. অপর একটি ফাঁকফোকর হলো, এই আইনের অধীনে দ্রুত বিচার ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। মামলার মীমাংসা হওয়ার আগ পর্যন্ত বাবা-মার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন ভরণ-পোষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এছাড়া, আদালত অভিযুক্ত সন্তানের কাছ থেকে জরিমানার টাকা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত বাবা-মাকে দিতে সক্ষম নয়। এই আইনে লঙ্ঘনের জন্য দুই লাখ টাকা জরিমানা ও ছয় মাসের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

৫. আইনের ৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, পিতা-মাতা কর্তৃক লিখিত অভিযোগ ছাড়া আদালত কোনো মামলা গ্রহণ করতে পারবে না। এটি আদালতের কার্যক্রমকে শর্তাধীন করে তুলেছে।

৬. আইন অনুযায়ী, সন্তানরা তাদের বাবা-মাকে জোর করে বৃদ্ধাশ্রমে বা আলাদা থাকতে বাধ্য করতে পারবে না। তবে যদি বাবা-মা আলাদাভাবে থাকতে চান, কিন্তু সন্তান দ্বৈত আবাসনের ব্যয় বহন করতে অসমর্থ হয়, তাহলে কী হবে সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। বাংলাদেশে পিতামাতার অধিকার নিশ্চিত করার কোনো স্পষ্ট বিধান নেই, ফলে অনেক বাবা-মা সন্তানের কাছ থেকে যথাযথ ভরণ-পোষণ পাচ্ছেন না।

৭. আইন অনুযায়ী, সরকারকে নিয়ম প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হলেও এখনো কোনো নিয়ম তৈরি হয়নি। এছাড়া, এই আইন দত্তক গ্রহণকারী বা নিঃসন্তান পিতামাতার ভরণ-পোষণের বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা দেয় না। আইনটি পিতা-মাতার আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেও এটি স্পষ্ট নয় যে তারা পারিবারিক আদালতে ভরণ-পোষণের জন্য দেওয়ানি মামলা করতে পারবেন কি না। জরিমানা বা অর্থ প্রাপ্তির বিষয়েও আইন নীরব।

৮. আইন অনুযায়ী, প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট পিতামাতার অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন এবং এটি আইনের দৃষ্টিতে আমলযোগ্য অপরাধ।

৯. বাংলাদেশে বেশিরভাগ বাবা-মা ও সন্তান এই আইনের বিষয়ে সচেতন নন। নিরক্ষরতার কারণে অধিকাংশ মানুষ এই আইন সম্পর্কে জানেন না। যারা জানেন, তারা আইনি জটিলতায় জড়াতে চান না। সন্তানদের প্রতি ভালোবাসার কারণে তারা ভরণ-পোষণ না পাওয়ার পরও আদালতে মামলা করেন না।

১০. অনেক বাবা-মা বিভিন্ন কারণে তাদের সন্তানদের থেকে আলাদা থাকেন। বিশেষ করে সন্তানদের স্ত্রীর কারণে অনেকে আলাদা থাকেন। অনেকে তাদের সম্পত্তি এক সন্তানকে দিয়ে দেন, ফলে অন্য সন্তানরা ভরণ-পোষণ দিতে অস্বীকার করেন। এছাড়া, পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে অনেক সন্তান বাবা-মাকে ভরণ-পোষণ দিতে চায় না।

১১. অনেক মানুষ জানেন না কীভাবে তারা তাদের প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের কাছ থেকে ভরণ-পোষণ নিতে পারেন। কিছু বাবা-মা আইন সম্পর্কে জানেন, কিন্তু সামাজিক মর্যাদা হারানোর ভয়ে মামলা করতে চান না।

১২. অনেক বাবা-মা সন্তানদের কাছ থেকে ভরণ-পোষণ দাবি করেন, কিন্তু তারা এই আইন সম্পর্কে জানেন না। তারা সাধারণত সালিশ বা সামাজিক মীমাংসার মাধ্যমে সন্তানদের কাছ থেকে ভরণ-পোষণ আদায়ের চেষ্টা করেন।

উপসংহার:

বাংলাদেশে পিতামাতার ভরণ-পোষণ শুধু নৈতিক দায়িত্বই নয়, এটি একটি আইনগত বাধ্যবাধকতাও। পিতামাতা ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩ নিশ্চিত করে যে বয়স্ক পিতামাতা তাদের সন্তানদের কাছ থেকে আর্থিক ও মানসিক সহায়তা পাবেন। তবে আইনগত কাঠামো থাকা সত্ত্বেও, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, যার মূল কারণ হলো সচেতনতার অভাব, সামাজিক বাধা এবং পরিবারের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে অনীহা।

আইনটির কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য সরকারকে প্রয়োগের ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে, আইন সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং বয়স্কদের প্রতি দায়িত্বশীলতার বিষয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিতের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার প্রবীণ জনগোষ্ঠীর মর্যাদা ও কল্যাণ রক্ষা করতে পারবে এবং একটি আরও মানবিক ও দায়িত্বশীল সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *