বাংলাদেশে অর্থপাচার একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক ও আইনি সমস্যা, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অর্থপাচার বলতে সাধারণত অবৈধভাবে অর্জিত অর্থকে বৈধ বলে উপস্থাপন করার প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়। গত কয়েক বছর ধরেই ডলার সংকট, ভঙ্গুর অর্থনীতি, মূল্যস্ফিতিসহ নানাবিধা টানাপোড়েনে দেশের অর্থনীতি, যার অন্যতম কারণ অর্থপাচার।
, এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা অর্থপাচার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে FATF (Financial Action Task Force) এবং এশিয়া-প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিং (APG)-এর সদস্য, যারা দেশের আর্থিক অপরাধ পর্যবেক্ষণ করে এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে সুপারিশ প্রদান করে।
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (GFI) ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, বাংলাদেশ থেকে অবৈধ বাণিজ্যিক লেনদেন ও হুন্ডির মাধ্যমে বছরে প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হচ্ছে। বেশিরভাগ অর্থপাচার ঘটে অতিমূল্যায়ন ও অধিমূল্যায়ন (Over-invoicing & Under-invoicing), হুন্ডি ও অবৈধ রেমিট্যান্স নেটওয়ার্ক, বিনিয়োগের নামে বিদেশে অর্থ স্থানান্তর, এবং ভুয়া রপ্তানি-আমদানি কার্যক্রম এর মাধ্যমে। বিশেষত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, কানাডা ও যুক্তরাজ্যে বিপুল পরিমাণ অর্থপাচারের তথ্য বিভিন্ন তদন্তে উঠে এসেছে।
বাংলাদেশে আলোচিত কিছু অর্থপাচার কেলেঙ্কারি দেশের আর্থিক ব্যবস্থার দুর্বলতা তুলে ধরে। যেমন, বহুল আলোচিত বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) কেলেঙ্কারি, যেখানে তিনি এবং তার সহযোগীরা প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছেন। তিনি কানাডায় পালিয়ে গেলেও ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে ভারতের কারাগারে আছেন। তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালতে অর্থপাচার মামলা চলছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থপাচার কেলেঙ্কারি হলো ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড মামলাটি, যেখানে মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং (MLM) ব্যবসার নামে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান রফিকুল আমীন এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা গ্রেফতার হয়ে বিচারের সম্মুখীন হন।
এছাড়া, বাংলাদেশের বৃহত্তম এনজিও ‘ব্র্যাক’-এর সাবেক কর্মকর্তা মিজানুর রহমানের অর্থপাচার মামলা আলোচিত হয়, যেখানে তিনি বিভিন্ন প্রকল্পের তহবিল তছরুপ করে বিদেশে সম্পদ গড়েন।
২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অফ নিউইয়র্ক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চুরি এবং ফিলিপাইনে পাচার করার ঘটনাটি ছিল আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং চক্রের একটি চাঞ্চল্যকর দৃষ্টান্ত। এই ঘটনায় সাইবার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরি করা হয়, যা পরে বিভিন্ন ক্যাসিনো এবং ব্যাংকের মাধ্যমে পাচার হয়।
বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ উঠেছে। যেমন, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পের আওতায় অর্থপাচারের অভিযোগ, যা পরবর্তীতে তদন্তের আওতায় আসে। এছাড়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ ও অর্থপাচারের তথ্য ফাঁস হয়েছে।
অর্থপাচার রোধে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও কার্যকর বাস্তবায়নের অভাবে সমস্যা প্রকট থেকে যাচ্ছে। অনেক মামলাতেই অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি, যার ফলে তারা আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। অধিকন্তু, রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক দুর্নীতি ও দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া অর্থপাচারের বিরুদ্ধে কার্যকর লড়াইয়ে বাধা সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশের জন্য অর্থপাচার মোকাবিলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষতি করে না, বরং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও চাপ সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ও BFIU-কে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। একইসঙ্গে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে অর্থপাচারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়।