গত দেড় দশকে বাংলাদেশে অর্থপাচার একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে স্বচ্ছতার অভাব, দুর্বল প্রশাসন, দুর্নীতি এবং জবাবদিহিতার সংকটের কারণে দেশ থেকে অর্থ পাচার খুব সহজ হয়ে উঠেছে। বৈশ্বিক বাণিজ্যিক কারসাজি, হুন্ডি এবং চোরাচালানসহ নানা মাধ্যমে দেশের বাইরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার হচ্ছে। বছরের পর বছর, শত শত বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে চলে যাচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য এক বিরাট ক্ষতি।
বাংলাদেশে অর্থপাচার প্রতিরোধে একটি আইন (মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন অ্যাক্ট ২০১২) আছে, তবে আইনের দুর্বল বাস্তবায়ন তার কার্যকারিতা সীমিত করে ফেলেছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU) এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এই অপরাধগুলো তদন্তের জন্য কাজ করছে, কিন্তু অন্যান্য প্রয়োজনীয় আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব এবং দুর্নীতির কারণে ব্যাপক অগ্রগতি করা সম্ভব হয়নি। আইনগত কাঠামো কার্যকর হওয়ার কথা হলেও এর বাস্তবায়ন আর্থিক খাতের দুর্বলতা, প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং বিশ্বব্যাপী অর্থপাচার চক্রের সাথে বাংলাদেশের সংযোগের কারণে সফল হয়নি।
বিশ্বব্যাপী মানি লন্ডারিং সংস্থাগুলির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর গড়ে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৭.৫৩ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়। ইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি’র ২০২৩ সালের প্রতিবেদনেও ২০২১ সালে ৮.১৫ বিলিয়ন ডলার পাচারের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এই পরিসংখ্যানগুলো দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির গভীরতা দেখায় এবং দেশের সুশাসনের অভাবকেই আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
অর্থপাচারে শুধু ব্যক্তিরাই জড়িত নয়, সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই অপরাধে অংশগ্রহণ করছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (CPD) এর তথ্য অনুযায়ী, ১৯টি ব্যাংকের মধ্যে ২৪টি ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এই ধরনের ঘটনাগুলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তৈরি করেছে।
অর্থপাচারের একটি বিখ্যাত কেলেঙ্কারি ছিল পি কে হালদার (প্রশান্ত কুমার হালদার) এর ঘটনা, যেখানে তিনি ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে তা বিদেশে পাচার করেছিলেন। আরও একটি উদাহরণ হলো ২০১৬ সালে ঘটে যাওয়া ঘটনা, যখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়ে নিউ ইয়র্ক ফেডের রিজার্ভ ব্যাংক থেকে ফিলিপাইনে পাচার করা হয়েছিল। এই ঘটনাগুলো বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থার দুর্বলতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অর্থপাচার চক্রের সঙ্গে দেশের সংশ্লিষ্টতা ফুটে তুলে।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে এবং এই সময়কালে ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। এসব অর্থ পাচারের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এর ফলে উন্নয়ন প্রকল্প ও দারিদ্র্য দূরীকরণে ব্যবহার করার জন্য যে অর্থ ছিল তা হারিয়ে গেছে, যা দেশের ভবিষ্যত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, অর্থপাচার রোধে দ্রুত এবং দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কার্যকর তদারকি, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে এই অপরাধগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। এছাড়া, গ্রাহক পরিচিতি (KYC) এবং সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্তকরণ (STR) ব্যবস্থাগুলোর বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক করতে হবে, যাতে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অবৈধ লেনদেন শনাক্ত করতে পারে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। আন্তর্জাতিক স্তরে যদি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি, যেমন FATF, Interpol, এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ব্যবহার করা যায়, তাহলে পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধার করা সহজ হবে। বাংলাদেশের আর্থিক খাতের দুর্বলতা দূর করতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির সক্রিয় ভূমিকা জরুরি।
অতীতে দেশে কিছু বড় বড় প্রযুক্তিগত উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, যা সন্দেহজনক লেনদেনের দ্রুত শনাক্তকরণে সাহায্য করতে পারে। এখন সময় এসেছে আধুনিক প্রযুক্তি যেমন ব্লকচেইন ব্যবহার করার, যা আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে এবং অবৈধ অর্থ গোপন করা আরও কঠিন করে তুলবে।
আইনগত কাঠামো শক্তিশালীকরণ, কার্যকর আইন প্রয়োগ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং সক্রিয় নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্থপাচার রোধ করা সম্ভব। বাংলাদেশের ভবিষ্যত আর্থিক স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য সব পক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে অবৈধ অর্থের প্রবাহ রোধ করা আবশ্যক।
এছাড়া, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ২৮ ট্রিলিয়ন টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। গড়ে প্রতি বছর ১.৮০ ট্রিলিয়ন টাকা পাচার হয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর্থিক মধ্যস্বত্বভোগী এবং সরকারি কর্মকর্তারা এই অর্থ পাচারে জড়িত ছিলেন। এটি বাংলাদেশের গভীর দুর্নীতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা তুলে ধরে, যা অবৈধ অর্থের স্থানান্তরকে উৎসাহিত করছে।
বাংলাদেশে অর্থপাচারের পরিসর অত্যন্ত বিপজ্জনক, এবং তা এখনই শক্তিশালী ও কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে মোকাবেলা করতে হবে। শক্তিশালী আইনের বাস্তবায়ন, আর্থিক তদারকির উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, যা দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং প্রবৃদ্ধিতে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।