আইন অঙ্গনে সমালোচনামূলক প্রথম ল জার্নাল

বাংলাদেশের শ্রম আইন, ২০০৬: প্রেক্ষাপট, উদ্দেশ্য ও বাস্তবায়ন

প্রবর্তনের উদ্দেশ্য :

বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ প্রণীত হয়েছিল বিদ্যমান শ্রম আইনগুলিকে একীভূত ও সংশোধন করে একটি সুসংগঠিত আইনি কাঠামো তৈরি করার লক্ষ্যে। এই আইনের মূল লক্ষ্য ছিল শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা, ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতকরণ এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা। বিশেষত, তৈরি পোশাক (RMG) শিল্পসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতের শ্রমিকদের সুরক্ষা ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করাই এই আইনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।

এই আইনটি বিডিও শ্রম-সংক্রান্ত বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করে, যেমন:-

১.বিচ্ছিন্ন শ্রম আইনগুলোর সংহতি: ১০০৬ সালের আগে বাংলাদেশের শ্রম আইন ২৫টি পৃথক আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। এই আইন তাদের একীভূত করে শ্রমিকদের জন্য একটি সহজবোধ্য ও সুসংগঠিত কাঠামো তৈরি করে।

২.কর্মসংস্থানের শর্তাবলী নির্ধারণ; শ্রমিক শ্রেণিবিভাগ, শিক্ষানবিশকাল, কর্মঘন্টা এবং চাকরি ছাঁটাই সংক্রান্ত বিধিবিধান স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

৩.ন্যায্য মজুরি ও সুবিধা নিশ্চিতকরণ; ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ এবং সময়মতো মজুরি পরিশোধ নিশ্চিত করতে নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।

৪.পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা: নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি, সুরক্ষা ব্যবস্থা ও শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের বিধান সংযোজন করা হয়েছে।

৫.ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের সুযোগ প্রদান: যৌথ দরকষাকষির মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ট্রেড

ইউনিয়ন গঠনের সুযোগ রাখা হয়েছে।

বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ:

তবে আইনটি কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে।

১. শ্রম আইন লঙ্ঘনের প্রবণতা: তৈরি পোশাক খাতসহ অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি না দেওয়া, অতিরিক্ত সময় কাজ করানো এবং কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শ্রমিক ন্যূনতম মজুরির নিচে বেতন পাচ্ছে এবং নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।

২.ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে প্রতিবন্ধকতা: আইনগতভাবে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অনুমতি থাকলেও কঠোর শর্ত ও উচ্চ শ্রমিক অংশগ্রহণের বাধ্যবাধকতা এই প্রক্রিয়াকে কঠিন করে তুলেছে।

৩.প্রয়োগের অপ্রতুলতা। শ্রম আইন বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত তদারকি ব্যবস্থা না থাকায় অনেক নিয়োগকর্তা এই আইনের শর্ত মানছে না।

৪.অনানুষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকদের সুরক্ষা নেই: শ্রম আইন মূলত প্রাতিষ্ঠানিক খাতের জন্য প্রণীত হয়েছে, ফলে অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বিপুল সংখ্যক শ্রমিক আইনগত সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকছে।

সাম্প্রতিক সংশোধন ও প্রভাব:

শ্রম আইনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে সরকার বেশ কয়েকটি সংশোধনী এনেছে, যার মধ্যে রয়েছে –

আইনের আওতা বৃদ্ধি: সামুদ্রিক জাহাজ শ্রমিকসহ পূর্বে অন্তর্ভুক্ত না থাকা শ্রমিকদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

মাতৃত্বকালীন সুবিধা নিশ্চিতকরণ: মাতৃত্বকালীন ছুটি ও আর্থিক সুবিধার বিধান আরও সুস্পষ্ট করা হয়েছে।

ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের শর্ত শিথিলকরণ: ইউনিয়ন গঠনের জন্য শ্রমিক অংশগ্রহণের নূনতম হয় কমিয়ে আনা হয়েছে, যাতে শ্রমিকদের অধিকতর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যায়।

তবে এই সংশোধনীগুলো শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যথেষ্ট কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, অন্তর্জাতিক শ্রম মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে আরও সংস্কারের প্রযোজন।

উপসংহার:

বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও, বাস্তবে এটি পুরোপুরি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। আইনের উদ্দেশ্য ও বাস্তব চিত্রের মধ্যে ব্যবধান কমাতে কার্যকর বাস্তবায়ন ব্যবস্থা, সকল শ্রমিক শ্রেণির অন্তর্ভুক্তি এবং আন্তর্জাতিক মানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ শ্রম আইন প্রণয়ন অপরিহার্য। শুধুমাত্র এর মাধ্যমে একটি ন্যায়সঙ্গত ও নিরাপদ শ্রম পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

তথ্যসূত্র:

১) FAOLEX “বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ FAOLEX

২) ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস বাংলাদেশে শ্রম পরিস্থিতি ও ন্যূনতম মজুরি পরিপালন সংক্রান্ত প্রতিবেদন ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস।

৩) রিসার্চগেট বিদ্যমান শ্রম আইন ও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কিত গবেষণা বিশ্লেষণ রিসার্চগেট।

৪) হিউম্যান রাইটস ওয়াচ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশের শ্রম আইন সংশোধনী সম্পর্কিত বিশ্লেষণ

৫) লিউ এজ বাংলাদেশ এজ বাংলাদেশের শ্রম আইন প্রযোগ সম্পর্কিত আলোচনা।

৬)এলএসই গ্রান্ডাম ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে শ্রমিক সুরক্ষার জন্য নীতিমালা।

৭) BLAST (বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট) শ্রম আইনের আওতায় ক্ষতিপূরণ দাবির মামলাগুলোর চ্যালেজ সম্পর্কিত প্রতিবেদন BLAST.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *