ভূমিকা
বিচার বিভাগ একটি দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ন্যায়বিচারের মৌলিক শর্ত। তবে বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থায় নানা ধরনের দুর্নীতি, স্বচ্ছতার অভাব ও রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে উঠে আসছে। এসব সমস্যার সমাধানের জন্য সরকার বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
বিচার ব্যবস্থায় দুর্নীতির কারণ ও প্রভাব
বাংলাদেশের বিচার বিভাগে দুর্নীতি বিদ্যমান থাকার পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে—
১. রাজনৈতিক প্রভাব: বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক চাপ ও অনুপ্রবেশ বিচারকদের স্বাধীন রায় প্রদানে বাধা সৃষ্টি করে।
2. প্রশাসনিক জটিলতা: মামলার দীর্ঘসূত্রিতা ও অব্যবস্থাপনা দুর্নীতির সুযোগ তৈরি করে।
3. নিম্ন পর্যায়ের দুর্নীতি: অনেক ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতে ঘুষ ও অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে মামলার রায় প্রভাবিত হয়।
4. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব: অনেক সময় বিচারিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা না গেলে দুর্নীতির ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
দুর্নীতি নিরসনে গৃহীত পদক্ষেপ
বাংলাদেশ সরকার ও বিচার বিভাগ দুর্নীতি দূর করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল—
১. বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিচার বিভাগকে প্রশাসন থেকে আলাদা করা হয়। এর ফলে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ কমে যায় এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়।
২. উচ্চ আদালতে বিচারকদের নিয়োগ পদ্ধতির উন্নয়ন
বর্তমানে বিচারকদের নিয়োগে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করা হয়। তবে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক নিয়োগ পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন।
৩. ডিজিটাল বিচার ব্যবস্থা
বর্তমানে ই-জুডিশিয়ারি ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, যার মাধ্যমে মামলার তথ্য অনলাইনে সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা করা হয়। এটি মামলার দীর্ঘসূত্রিতা কমাতে সহায়তা করছে।
৪. দুর্নীতিবিরোধী কমিশনের (দুদক) কার্যক্রম বৃদ্ধি
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিচার বিভাগের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
৫. নিম্ন আদালতে নজরদারি বৃদ্ধি
নিম্ন আদালতের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নিয়মিত পরিদর্শন ও শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। বিচারকদের আচরণবিধি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
বিচার ব্যবস্থার সংস্কার ও উন্নয়ন
বিচার বিভাগকে আরও কার্যকর ও জনবান্ধব করতে কয়েকটি সংস্কার করা হয়েছে—
1. মামলার জট কমানোর উদ্যোগ: বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (ADR) পদ্ধতির প্রচলন করা হয়েছে, যাতে আদালতের বাইরে সমঝোতার মাধ্যমে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করা যায়।
2. নাগরিকদের জন্য আইনি সহায়তা: দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য সরকারি আইন সহায়তা সেল চালু করা হয়েছে।
3. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত: নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে।
4. আদালতের অবকাঠামোগত উন্নয়ন: বিচারালয় আধুনিকীকরণ, নতুন কোর্ট রুম নির্মাণ ও বিচারকদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা হয়েছে।
সমালোচনা ও চ্যালেঞ্জ
বিচার বিভাগ সংস্কারের নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে—
1. রাজনৈতিক চাপ: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এখনও সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হয়নি।
2. দুদকের কার্যকারিতা: দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
3. দীর্ঘসূত্রিতা: মামলার নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লাগার কারণে বিচারপ্রার্থী জনগণের ভোগান্তি বাড়ছে।
4. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব: কিছু ক্ষেত্রে বিচারিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।
উপসংহার
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের দুর্নীতি দূর করতে এবং স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বিচার ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও জনবান্ধব করতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচারব্যবস্থা, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং জবাবদিহিমূলক সংস্কার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তবেই ন্যায়বিচার জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাবে এবং আইনের শাসন সুসংহত হবে।