আইন অঙ্গনে সমালোচনামূলক প্রথম ল জার্নাল

বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা: একটি আইনি বিশ্লেষণ

ভূমিকা

নির্বাচন হলো একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জনগণের একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী সরকারি পদে দায়িত্ব পালনের জন্য ব্যক্তিদের নির্বাচন করে। ভোটদান ব্যবস্থা হলো একটি নির্দিষ্ট নিয়মের সমষ্টি, যা নির্বাচন কীভাবে পরিচালিত হবে এবং ফলাফল কীভাবে নির্ধারিত হবে তা নির্ধারণ করে। এই ব্যবস্থা রাজনৈতিক নির্বাচন থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং অনানুষ্ঠানিক সংগঠনের নির্বাচন পর্যন্ত প্রযোজ্য। এটি নির্বাচনের সময়সূচি, ভোটারদের যোগ্যতা, প্রার্থীদের যোগ্যতা এবং ব্যালট কীভাবে প্রদান ও গণনা করা হবে, সেসব বিষয়ে নিয়ম নির্ধারণ করে।

এছাড়া, নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য ব্যয় ব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য প্রভাবশালী বিষয়গুলোও এই ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত। সাধারণত, একটি দেশের সংবিধান ও আইনের মাধ্যমে রাজনৈতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা নির্ধারিত হয় এবং এটি পরিচালনার জন্য একটি নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালন করে।

নির্বাচন কমিশন

নির্বাচন কমিশন একটি স্বতন্ত্র সংস্থা, যা কোনো দেশের নির্বাচনের সংগঠন ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে থাকে। বিভিন্ন দেশে এটি “নির্বাচনী কমিশন,” “নির্বাচন বোর্ড” বা “নির্বাচনী আদালত” নামে পরিচিত হতে পারে। কিছু দেশে এটি সম্পূর্ণ স্বাধীন, আবার কিছু ক্ষেত্রে এটি সরকারি প্রশাসনের অংশ হিসেবে কাজ করে।

এর মূল দায়িত্ব হলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা, স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সংরক্ষণ করা। অনেক ক্ষেত্রে এটি নির্বাচনী সীমানা পুনর্বিন্যাসের দায়িত্বও পালন করে।

বাংলাদেশে নির্বাচনের আইনগত কাঠামো

বাংলাদেশের আইনসভা এককক্ষবিশিষ্ট (unicameral) এবং ৩৫০টি আসনবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ (জাতীয় সংসদ) নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে ৩০০টি আসনে সরাসরি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং পাঁচ বছর মেয়াদে সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হন। বাকি ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকে, যা শাসক দল বা জোট কর্তৃক মনোনীত হয়।

প্রধানমন্ত্রী সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, আর রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে মূলত আনুষ্ঠানিক ভূমিকা পালন করেন। রাষ্ট্রপতিকে জাতীয় সংসদ সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত করা হয়।

বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা সংবিধান ও “প্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২” দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যা নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার মূল আইনি ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা

সংবিধান ও আইনগত কাঠামো

বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন একটি সংবিধান স্বীকৃত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, যা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত। সংবিধানের ১১৮(৪) ও ১২৬ অনুচ্ছেদ এবং প্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

যদিও সংবিধানে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে, এটি কিছু নির্দিষ্ট সংবিধানিক ও আইনি বিধানের আওতাধীন। কমিশন নির্বাচনের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে, যাতে নির্বাচন অবাধ ও স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হয়।

স্বাধীনতার চ্যালেঞ্জসমূহ

সংবিধানগত সুরক্ষা থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিয়ে প্রায়শই প্রশ্ন ওঠে। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ডে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে, যার ফলে কমিশনের ক্ষমতা খর্ব হয়।

এছাড়া, প্রশাসনিক নির্ভরতা, পর্যাপ্ত আর্থিক সংস্থান না থাকা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতার অভাব কমিশনের কার্যকারিতা ব্যাহত করে।

নির্বাচন কারচুপি ও ভোট দমন সংক্রান্ত অভিযোগও নির্বাচন ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করে। এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রয়োজন।

বিচারিক ব্যাখ্যা ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তবে সেসব রায় সবসময় কার্যকর করা হয় না। ফলে কমিশনের কার্যক্রমে অসঙ্গতি দেখা দেয়।

অপরদিকে, ভারতের নির্বাচন কমিশন এবং যুক্তরাজ্যের নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা তুলনামূলকভাবে বেশি। ভারতে নির্বাচন কমিশন ভোট পরিচালনার ক্ষেত্রে শক্তিশালী আইনগত ও প্রশাসনিক সুরক্ষা ভোগ করে এবং নির্বাচন সংক্রান্ত ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে।

যুক্তরাজ্যের নির্বাচন কমিশনের আর্থিক স্বাধীনতা রয়েছে, যা তাদের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকতে সহায়তা করে। এই তুলনামূলক বিশ্লেষণ দেখায় যে, বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা রক্ষায় আরও সাংবিধানিক ও আইনি সংস্কার প্রয়োজন।

নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার সুপারিশ

স্বাধীনতা বৃদ্ধি করা

নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমকে স্বাধীন রাখতে এর কর্মকর্তাদের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রদান, অনিয়মের কারণে নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা এবং নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেওয়া প্রয়োজন।

অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সরকারের সংরক্ষিত তহবিল (Consolidated Fund) থেকে সরাসরি বরাদ্দ প্রদান করতে হবে, যাতে এটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকতে পারে।

রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা

নির্বাচন কমিশনারদের স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন করা যেতে পারে, যা নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের দায়িত্ব পালন করবে।

এছাড়া, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলে রাজনৈতিক অস্থিরতা কমবে এবং নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।

অতীত নির্বাচন তদন্ত করা

২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনগুলোর তদন্ত করতে একটি বিশেষ কমিশন গঠন করা উচিত।

যারা নির্বাচন কারচুপিতে জড়িত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনসহ (International Crimes Tribunal Act) বিদ্যমান আইনের অধীনে দোষীদের অযোগ্য ঘোষণা করা দরকার।

জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন করা

জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করলে কেন্দ্রীয় রাজনীতির প্রভাব কমানো সম্ভব হবে।

এতে রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে এবং গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্তিশালী হবে।

বিচারিক তদারকি শক্তিশালী করা

নির্বাচন সংক্রান্ত মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য একটি বিশেষ নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল গঠন করা প্রয়োজন।

এতে আইনি সহায়তা দ্রুত পাওয়া যাবে এবং নির্বাচনী অনিয়ম কমানো সম্ভব হবে।

জনসচেতনতা ও ভোটার শিক্ষা

ভোটারদের সচেতন করতে প্রচার-প্রচারণা বাড়ানো দরকার, যাতে তারা ভুল তথ্য থেকে বাঁচতে পারে এবং নির্বাচনী প্রতারণা প্রতিরোধ করতে পারে।

নির্বাচন কমিশনের উচিত সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের সঙ্গে কাজ করে ভোটারদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

উপসংহার

একটি স্বাধীন, স্বচ্ছ এবং কার্যকর নির্বাচন কমিশন একটি সুস্থ গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশে নির্বাচনী ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষায় কমিশনের স্বাধীনতা বাড়াতে হবে এবং অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কার আনতে হবে।

সবার আগে রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

এছাড়া, অন্য গণতান্ত্রিক দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, যা দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত রাখবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *