গৃহস্থালি সহিংসতা একটি বৈশ্বিক সমস্যা যা ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থ-সামাজিক সীমানা অতিক্রম করে এবং এটি মানবাধিকার লঙ্ঘন ও একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত। এই সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধি করে অনেক দেশ গৃহস্থালি সহিংসতা মোকাবিলায় আইন প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশে গৃহস্থালি সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ গৃহস্থালি সহিংসতা মোকাবিলায় একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত। তবে, আইনটির প্রগতিশীল বিধান সত্ত্বেও বাস্তবায়নে নানা আইনি ও ব্যবহারিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা আইনটির কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।
প্রথমত, গৃহস্থালি সহিংসতার শিকারদের জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্রের অভাব। এর ফলে অনেকেই সহিংসতার শিকার হওয়ার পর নিরাপদ আশ্রয়ের অভাবে সাহায্য পায় না এবং তারা আরও বিপদে পড়ে। সরকার এবং সমাজের উচিত, এ বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া।
দ্বিতীয়ত, সাধারণ জনগণ এবং আইনজীবীদের মধ্যে এই আইন সম্পর্কে পর্যাপ্ত সচেতনতার অভাব। এই আইনটির সঠিক প্রয়োগ এবং শিকারদের সাহায্য করার জন্য জনগণ ও আইনজীবীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ সচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে।
তৃতীয়ত, পারিবারিক সহিংসতা প্রায়ই সামাজিক নিয়মাবলীর কারণে গোপন থাকে। অনেক পরিবারে এটি লজ্জার বিষয় হিসেবে দেখা হয়, যা শিকারদের মুখ খুলতে বাধা দেয়। এর ফলে, সহিংসতার শিকাররা সাহায্য পাওয়ার সুযোগ হারায় এবং এটি সমাজে একটি অদৃশ্য সমস্যা হিসেবে রয়ে যায়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে গৃহস্থালি সহিংসতার মামলাগুলির বিচার প্রক্রিয়া প্রায়ই বিলম্বিত হয়, যা শিকারদের জন্য বড় সমস্যা সৃষ্টি করে। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া মানসিক আঘাত এবং আর্থিক অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা শিকারদের জন্য নিরুৎসাহিতকারী হতে পারে। সুরক্ষা আদেশ বা ক্ষতিপূরণ পেতে বিলম্ব আইনটির প্রদত্ত আইনি প্রতিকারকে অকার্যকর করে তুলতে পারে, ফলে শিকাররা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এছাড়াও গৃহস্থালি সহিংসতা আইনের বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রে অসঙ্গতিপূর্ণ হয়েছে। অনেক সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি গৃহস্থালি সহিংসতার অভিযোগকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি বা পারিবারিক বিষয় হিসেবে হস্তক্ষেপ করতে অপ্রস্তুত ছিল। এই অসঙ্গতিপূর্ণ প্রয়োগ আইনটির কার্যকারিতা হ্রাস করে এবং শিকারদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা প্রদান করতে ব্যর্থ হয়।
গৃহস্থালি সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ আইনটিকে সামনে রেখে কিছু প্রস্তাবনা আনা যেতে পারে। প্রথমত, সচেতনতা প্রচারণা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। গৃহস্থালি সহিংসতা আইনের বিধান সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার জন্য সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলো (এনজিও) ব্যাপক সচেতনতা প্রচারণা চালানো উচিত। এই প্রচারণাগুলো শহর ও গ্রামীণ উভয় এলাকায় লক্ষ্য করা উচিত এবং সর্বাধিক পৌঁছানোর জন্য স্থানীয় ভাষায় পরিচালনা করা উচিত। এছাড়াও, আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা, বিচারক ও আইনজীবীদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আয়োজন করা উচিত যাতে তারা আইনটির বিষয়ে তাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করতে পারে এবং গৃহস্থালি সহিংসতার মামলা পরিচালনার দক্ষতা উন্নত করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, সম্প্রদায় সম্পৃক্ততা ও সংবেদনশীলতা সম্পর্কিত সমস্যা দূর করা যেতে পারে। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কলঙ্ক কাটিয়ে উঠতে সম্প্রদায় সম্পৃক্ততা ও সংবেদনশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় নেতা, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও সম্প্রদায় সংগঠনগুলোকে গৃহস্থালি সহিংসতা সম্পর্কে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রচেষ্টায় সম্পৃক্ত করা উচিত। গণ আলোচনা, কর্মশালা ও মিডিয়া প্রচারণা গৃহস্থালি সহিংসতার স্বাভাবিকীকরণকে চ্যালেঞ্জ করতে এবং শিকারদের সাহায্য চাইতে উৎসাহিত করতে সাহায্য করতে পারে।
তৃতীয়ত, আইনি সহায়তা ও সহায়তা সেবা শক্তিশালীকরণ করতে হবে। গৃহস্থালি সহিংসতার শিকারদের জন্য আইনি সহায়তা ও সহায়তা সেবা শক্তিশালী করার জন্য সরকারকে আরও সম্পদ বরাদ্দ করা উচিত। এর মধ্যে রয়েছে বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় আইনি সহায়তা ক্লিনিকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা এবং শিকারদের বিনামূল্যে বা সাশ্রয়ী মূল্যে আইনি প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। এছাড়াও, আরও আশ্রয়কেন্দ্র ও কাউন্সেলিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা শিকারদের তাদের জীবন পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করতে পারে।
চতুর্থত, বিচারিক প্রক্রিয়া যথাসম্ভব দ্রুততর করা। বিচারিক প্রক্রিয়ার বিলম্ব মোকাবিলার জন্য সরকার গৃহস্থালি সহিংসতার মামলার জন্য বিশেষায়িত আদালত বা দ্রুত ট্র্যাক আদালত প্রতিষ্ঠার কথা বিবেচনা করতে পারে। এই আদালতগুলো প্রশিক্ষিত বিচারক ও কর্মী দ্বারা সজ্জিত হওয়া উচিত যারা মামলাগুলো দক্ষ ও সংবেদনশীলভাবে পরিচালনা করতে পারে। এছাড়াও, মধ্যস্থতার মতো বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ার ব্যবহার মামলাগুলো দ্রুত সমাধান করতে এবং আদালতের বোঝা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
পঞ্চমত, মনিটরিং ও জবাবদিহিতা প্রক্রিয়া শক্তিশালীকরণ করতে হবে। গৃহস্থালি সহিংসতা আইনের সঙ্গতিপূর্ণ বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে শক্তিশালী মনিটরিং ও জবাবদিহিতা প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করা উচিত। এর মধ্যে রয়েছে পুলিশ বাহিনীর মধ্যে গৃহস্থালি সহিংসতার মামলা পরিচালনার জন্য একটি নির্দিষ্ট ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা এবং অভিযোগগুলি দ্রুত ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করা নিশ্চিত করা। গৃহস্থালি সহিংসতার মামলার নিয়মিত অডিট ও পর্যালোচনা বাস্তবায়নের ফাঁকগুলি চিহ্নিত করতে এবং আইনটি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করতে পারে।
গৃহস্থালি সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ বাংলাদেশে গৃহস্থালি সহিংসতা মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও, এর কার্যকারিতা বিভিন্ন আইনি ও ব্যবহারিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সচেতনতা প্রচারণা, সম্প্রদায় সম্পৃক্ততা, আইনি সহায়তা ও সহায়তা সেবা শক্তিশালীকরণ, বিচারিক প্রক্রিয়া দ্রুততর করা এবং শক্তিশালী মনিটরিং ও জবাবদিহিতা প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করে আইনটির বাস্তবায়ন উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করা যেতে পারে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, সরকার, সুশীল সমাজ এবং সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি সহিংসতামুক্ত সমাজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব।
তথ্যসূত্র
বাংলাদেশ সরকার. (২০১০). গৃহস্থালি সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন. (২০১৮). গৃহস্থালি সহিংসতা ও আইনি সহায়তা: একটি পর্যালোচনা. ঢাকা: মানবাধিকার কমিশন।
আলম, এম. (২০১৯). গৃহস্থালি সহিংসতা: আইনি প্রতিকার ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা।
সানজিদা, আর. (২০২০). গৃহস্থালি সহিংসতা আইনের বাস্তবায়ন: চ্যালেঞ্জ ও সমাধান। ঢাকা: জাতীয় আইন স্কুল।
সিদ্দিকী, এম. (২০১৭). গৃহস্থালি সহিংসতা: সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি। ঢাকা: বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা. (২০১৩). গৃহস্থালি সহিংসতা: প্রভাব ও প্রতিকার। জেনেভা: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা. (২০১৫). গৃহস্থালি সহিংসতা এবং জনস্বাস্থ্য। জেনেভা: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
নূর, স. (২০২১). বিচারিক প্রক্রিয়া ও গৃহস্থালি সহিংসতা: সমস্যা ও সমাধান। ঢাকা: বাংলাদেশ বিচারিক কমিশন।