মধ্যযুগে ইউরোপে ল্যাটিন ভাষা জানা পাদ্রিরাই শুধু বাইবেল পড়তে পারতো। ভারতীয় উপমহাদেশেও সংস্কৃত জানা ব্রাহ্মণরা বেদ পাঠ করত। এই সংস্কৃতি একসময় কুসংস্কারে পরিণত হয় এবং মানুষের মধ্যে গেঁথে যায় যে, ধর্মগ্রন্থগুলো পাঠ শুধু তাদেরই অধিকার যারা পাদ্রী, পুরোহিত বা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়। আধুনিকতার বিকাশে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ এবং জ্ঞানের বহুল প্রচারণায় এই কুসংস্কারের সংস্কার হয়েছে। এখন সবাই নিজ ধর্ম সম্পর্কে বেশ ভালোই জানে।সবাই নিজ নিজ জায়গা থেকে চর্চা করে। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও একই বিপ্লব ঘটেছে,তৃণমূল পর্যায়ের জনগণও এখন প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে জানে, কোন সমস্যা হলে দৌড়ে যায় হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে। কিন্তু সমাজের অন্যতম অঙ্গ আইনের ক্ষেত্রে এখনও তা ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়দের বিষয়। সাধারণ জনগণ জানে না কোনটা তাদের অধিকার, কোনটা কর্তব্য।
সহজেই সমাধান পাওয়া যাবে এমন কোন হাতুড়ে আইনজীবীও নেই,আইন সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে আইনের মাহ্ফিল্ও হয় না। যতটুকু হয় তাও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ক্লাসেই সীমাবদ্ধ। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয়টি হলো বেশিরভাগ নাগরিক অধিকার হতে বঞ্চিত হলেও, তারা এটাই জানে না যে তাদের এই ধরণের সমস্যার সম্মুখীন না হওয়া তাদের অধিকার ছিল। যেমন : শব্দ দূষণের কথা বলা যেতে পারে।
একটি রাষ্ট্রের সুস্থ বিকাশ নির্ভর করে এর জনগণের অধিকার সচেতনতার উপর। রাষ্ট্র জনগণকে কি কি অধিকার ও কর্তব্য প্রদান করবে এ সম্পর্কে ধারণা সচেতনতা তৈরি করে। যার ফলাফল স্বরুপ অনেক ধরণের আর্থসামাজিক সমস্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।যেমন: ১৮ বছরের কম বয়সী কারো নিকট তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।^ ১ এই আইনটির বহুল প্রচারে আমাদের সমাজে চলমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা লাঘব হতো। কিশোর বয়সে মাদকাসক্তের সংখ্যা কমে যেত।
মনে করেন মহাসড়কে পথচারী হিসেবে নির্দিষ্ট পথ দিয়ে না চলায় আপনার বিরুদ্ধে মামলা হলো, তখন আপনি এই বলে রেহাই পাবেন না যে আমি এই আইন জানতাম না।কারণ, আইন দেবতার মূলনীতি “Ignorantia Juris Non Excusat” অর্থাৎ আইন না জানা কোন অজুহাত হতে পারে না।
অর্থাৎ, আইন জানা এবং মানা ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনে অগ্রগতির এক অন্যতম সোপান।
কিছু জনগুরুত্বপূর্ণ আইন রয়েছে যা আমাদের দেশের অধিকাংশ নাগরিক জানেন না। যদিও সব আইন জনগুরুত্বপূর্ণ , কিন্তু কিছু আইন রয়েছে যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সুস্থ সামাজিক ভারসাম্য ও পরিবেশ রক্ষায় বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারে। যেমন : শব্দদূষণ বিধিমালা ২০০৬। রাষ্ট্রের সকল সামাজিক অর্থনৈতিক প্রকল্প জনগণের মঙ্গলের জন্য হওয়া সত্ত্বেও যেমন বাঁধ নির্মাণ, ব্রীজ নির্মাণ ইত্যাদি প্রকল্পকে নির্দিষ্ট করে জনগুরুত্বপূর্ণ বলা হয়; তেমনি প্রাত্যহিক জীবনের কিছু নির্দিষ্ট আইনকে জনগুরুত্বপূর্ণের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আমরা প্রায়ই বাড়ি ভাড়া নিয়ে বাসার মালিকের সাথে বাক-বিতণ্ডায় জড়াই, অনেক বাসার মালিক কয়েক মাসের জন্য অগ্রীম ভাড়া নেন। এই বিষয়ে “বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১”
নামক একটি বিধিমালা রয়েছে । যার ২৩(ই)) ধারায় বলা হয়েছে “উক্ত মালিক ১ মাসের অতিরিক্ত যে টাকা আদায় করেছেন, তিনি তার দ্বিগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং পরবর্তী প্রত্যেক বারের জন্য তিনগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।” ^২ উক্ত আইনে ভাড়াটিয়াদের বিরুদ্ধেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভাড়া পরিশোধ করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে।
চলাফেরার পথে এবং টেলিভিশন, ফোন ইত্যাদির পর্দায় আমরা হরহামেশাই বিভিন্ন যৌন রোগের চিকিৎসা বিষয়ক অবাঞ্ছনীয় বিজ্ঞাপন দেখতে পাই, সামাজিক জীবনে যা অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করে। এ বিষয়টিও আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। অবাঞ্ছনীয় বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯২, নামক আইনটির ৩ ধারায় বলা হয়েছে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোন ব্যক্তির চিগিৎসার দ্বারা কোন যৌন সংসর্গ বা অন্য রোগের প্রতিকার করার প্রস্তাব করা অথবা এই সম্পর্কিত উপদেশ দেওয়ার প্রস্তাব করা যাবে না।^৩ আইনটির ৪ ধারায় এরূপ কর্মকাণ্ডের শাস্তি স্বরূপ ১ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ১ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। ^৪
আবাসিক এলাকায় প্রায়ই নির্মাণ কাজের জন্য ব্যবহৃত ইট, পাথর ভাঙ্গার মেশিনের বিকট শব্দে মানুষের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬ এর ১১তম বিধি মোতাবেক আবাসিক এলাকার ৫০০ মিটারের মধ্যে এই ধরণের মেশিন ব্যবহার করা যাবে না। ^৫ এই বিধিমালার ১৮ বিধি মোতাবেক এই আইন লঙ্ঘনের শাস্তিস্বরূপ ১ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দন্ড। পরবর্তী অপরাধের জন্য ৬ মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা দশ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।^৬
সাধারণত হাসপাতাল, স্কুল,কলেজ বা অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশেপাশের এলাকায় শব্দ দূষণ একটা অপূরণীয় ক্ষতির সামিল। উক্ত প্রতিষ্ঠান গুলোর গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম বাঁধাগ্রস্ত হয় এই শব্দ দূষণ দ্বারা। তাই ২০০৬ সালের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালার ২(ঞ) তে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকাকে নীরব এলাকা বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।যার মধ্যে রয়েছে হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস, আদালত এবং এর চতুর্দিকের ১০০ মিটার এলাকা। ^৭ উক্ত বিধিমালার ৮ ধারায় বলা হয়েছে এসব এলাকায় যানবাহন চলাচলের সময় নিউম্যাটিক,হাইড্রলিক বা মাল্টিটিউন হর্ণ ব্যবহার করা যাবে না।
কিন্তু চালকরা এই নীরব এলাকার নামই শুনেন নি, আইন মানা তো বিলাসিতা।
বনভোজন বা পিকনিকে যাওয়ার পথে স্পিকার ব্যবহার না করা যেন একটা পাপ। লাউড স্পিকার বা এই ধরণের সাউন্ড সিস্টেম পরিবেশ সুস্থ রাখার অন্তরায়। উক্ত আইনের ১০ বিধিতে এই ধরণের কর্মকাণ্ডকেও বেআইনী বলা হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের আইন লঙ্ঘন ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অজ্ঞ নির্বিশেষে আমরা সকলেই করে থাকি।
সাধারণত প্রচারণার জন্য দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো একটি প্রচলিত প্রথা। কিন্তু এই পোস্টার নির্দিষ্ট স্থানে না লাগিয়ে লাগানো হয় বাসা বাড়ির দেয়ালে, বৃক্ষ, বিদ্যুতের খুঁটি, রাস্তা ঘাটে। যা নগরীর সৌন্দর্য নষ্ট করে। এ সম্পর্কিত একটি আইন প্রণয়ন করা হয় ২০১২ সালে,দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো নিয়ন্ত্রণ আইন। উক্ত আইনের ৩ ধারায় নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্য কোথাও দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগালে তা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। ^৮ উক্ত বিধান লঙ্ঘনের শাস্তি হচ্ছে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড,অনাদায়ে যা ১৫ দিন পর্যন্ত কারাদণ্ড বা নিজ খরচে পোস্টার বা দেয়াল লিখন অপসারণ করার আদেশ। ৯
তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য সেবন একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। নেশাগ্রস্ত ছাড়াও সাধারণ মানুষরাও ধীরে ধীরে সমাজে তামাক সেবনকে একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত করেছে।যার প্রভাব পড়েছে কিশোর বয়সীদের উপর। মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটানোর পাশাপাশি নিজের শরীর ও মনকে কিশোর বয়স থেকেই ধ্বংস করছে তারা। ধুমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০৫ এর ধারা ৬ক অনুসারে ১৮ বছরের কারো নিকট তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করা একটি দন্ডনীয় অপরাধ।
^১০ অর্থাৎ তাদের কাছে সিগারেট বিক্রি করাও যাবে না। উক্ত ধারা মতে এ আইন লঙ্ঘনের শাস্তিস্বরূপ ৫০০০ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড এবং পুনরায় এই অপরাধ করলে পর্যায়ক্রমিক ভাবে দ্বিগুণ হারে দন্ডের বিধান রয়েছে। এ আইনের প্রয়োগ আমাদের দেশে যেন অমাবস্যার চাঁদ।
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু, এ ধরণের খবর পত্রিকায় নিয়মিত ছাপতে হয়। সাধারণত চালককেই এই অপরাধে দোষী করা হয়। কিন্তু মহাসড়কে চলাচলের সময় পথযাত্রীদেরও যে কিছু কর্তব্য রয়েছে, সে আইন কি আমরা মেনে চলি। মহাসড়ক আইন ২০২১ এর ৯(২) ধারা অনুসারে মহাসড়কে নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্য স্থান দিয়ে পদযাত্রা করা যাবে না। অর্থাৎ যেকোনো স্থান দিয়ে রাস্তা পার হওয়া যাবে না। এই আইন লঙ্ঘনের শাস্তি স্বরূপ ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।^১১
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ৬ (ক) ধারা অনুসারে পলিথিনের শপিং ব্যাগ বা অন্য কোন সামগ্রী যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, সেসব উৎপাদন, বাজারজাতকরণ,বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, পরিবহন ইত্যাদি নিষিদ্ধ। আইনটির ১৫ ধারায় বলা হয়েছে উক্ত বিধান লঙ্ঘনের শাস্তি ২ বছর কারাদণ্ড বা ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত। তার পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের জন্য ২ বছর থেকে ১০ বছর কারাদণ্ড বা ২ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। এই আইনের প্রয়োগ থাকলে দেশের অনেক পরিবেশ দূষণগত সমস্যা ও এর দীর্ঘমেয়াদী বিস্তৃত বিরূপ
প্রভাব প্রতিরোধ করা সম্ভব হতো।
কেন এই আইন গুলো বাস্তবায়িত হয় না?
অধিকাংশ নাগরিক উক্ত জনগুরুত্বপূর্ণ আইনগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা রাখে না। অন্যদিকে উপরিউক্ত সমস্যাগুলো একটি সুস্থ নাগরিক সমাজ বিকাশের অন্তরায়।সড়কে আইন মেনে চলা অনেকের অকাল মৃত্যু থেকে রক্ষা করতে পারে। নীরব এলাকা হিসেবে আখ্যায়িত স্কুল, হাসপাতালের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গার আশেপাশে শব্দদূষণ রোধ – শিক্ষা, চিগিৎসা উভয় ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় পরিবেশ বজায় রাখবে। নির্দিষ্ট স্থানে পোস্টার লাগানো নগরের সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ রাখবে। তামাকজাত দ্রব্য সম্পর্কিত আইনগুলোর বাস্তবায়ন নাগরিকদের সুস্থ, স্বাভাবিক বিকাশে সহায়তা করবে। যা দীর্ঘমেয়াদে একটি রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সহায়তা করবে।
অর্থাৎ বৃহৎ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র পরিসর থেকে তৎপরতা শুরু করা উচিত। কতিপয় বিষয়গুলোকে একীভূত করে উক্ত আইনগুলোর অধীনে একটি “আইন তৎপরতা কার্যক্রম” পরিচালনা করা যেতে পারে। প্রত্যেক থানায় কিছু সংখ্যক সেল গঠন করে এলাকা গুলো পর্যবেক্ষণ, জনসচেতনতা তৈরি করা যেতে পারে। প্রতি একমাস অন্তর অন্তর এই ধরণের কার্যক্রম পরিচালনা ও আইন ভঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে জনগুরুত্বপূর্ণ আইনগুলো সত্যিকার অর্থে একটি সুন্দর, সুশীল রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করবে।